খানিকটা কোলে-পিঠে, খানিকটা টেনে-হিচড়ে তিনি আমাকে স্টেশনের বাইরে এনে একটা টাঙ্গায় বসালেন। আমি তখন শুধু ভাবছি ভদ্রলোক আমাকে চেনেন না জানেন না, আমি বাঙালী তিনি পাঠান, তবে যে এত সম্বর্ধনা করছেন তার মানে কি? এর কতটা আন্তরিক, আর কতটা লৌকিকতা?
আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা আন্তরিক। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মত আনন্দ পাঠান অন্য কোনো জিনিসে পায় না আর সে অতিথি যদি বিদেশী হয় তা হলে তো আর কথাই নেই। তারো বাড়া, যদি সে অতিথি পাঠানের তুলনায় রোগাদুবলা সাড়েপাঁচফুটী হয়। ভদ্রলোক পাঠানের মারপিট করা মানা। তাই সে তার শরীরের অফুরন্ত শক্তি নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না। রোগাদুবলা লোক হাতে পেলে আর্তকে রক্ষা করার কৈবল্যানন্দ সে তখন উপভোগ করে— যদিও জানে যে কাজের বেলায় তার গায়ের জোরের কোনো প্রয়োজনই হবে না।
টাঙ্গা তো চলেছে পাঠানী কায়দায়। আমাদের দেশে সাধারণত লোকজন রাস্তা সাফ করে দেয় গাড়ি সোজা চলে। পাঠানমুলুকে লোজন যার যে রকম খুশী চলে, গাড়ি একেবেঁকে রাস্তা করে নেয়। ঘণ্টা বাজানো, চিৎকার করা বৃথা। খাস পাঠান কখনো কারো জন্যে রাস্তা ছেড়ে দেয় না। সে স্বাধীন, রাস্তা ছেড়ে দিতে হলে তার স্বাধীনতা রইল কোথায়? কিন্তু ঐ স্বাধীনতার দাম দিতেও সে কসুর করে না। ঘোড়ার নালের চাট লেগে যদি তার পায়ের এক খাবলা মাংস উড়ে যায় তাহলে সে রেগে গালাগালি, মারামারি বা পুলিশ ডাকাডাকি করে না। পরম অশ্রদ্ধা ও বিরক্তি সহকারে ঘাড় বাঁকিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করে, দেখতে পাস না? গাড়োয়ানও স্বাধীন পাঠান— ততোধিক অবজ্ঞা প্রকাশ করে বলে, তোর চোখ নেই? ব্যস্। যে যার পথে চলল।
দেখলুম পেশাওয়ারের বারো আনা লোক আহমদ আলীকে চেনে, আহমদ আলী বোধ হয় দশ আনা চেনেন। দুমিনিট অন্তর অন্তর গাড়ি থামান আর পশতু জবানে কি একটা বলেন; তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জানান, আপনার সঙ্গে খেতে বললুম। আপত্তি নেই তো?
আহমদ আলীর স্ত্রীর সৌভাগ্য বলতে হবে কারণ তিনিই বঁধেন, পর্দা বলে বাড়েন না যে তাদের বাড়ি স্টেশনের কাছে, না হলে সে রাত্রে আহমদ আলীর বাড়িতে পাঠানমুলুকের জিরগা বসে যেত।
সরল পাঠান ও সুচতুর ইংরেজে একটা জায়গায় মিল আছে। পাঠানমাত্রই ভাবে বাঙালী বোমা মারে, ইংরেজেরও ধারণা অনেকটা তাই। আহমদ আলী সি, আই, ডি, ইন্সপেক্টর। আমি তার বাড়ি পৌঁছবার ঘণ্টাখানেকের ভিতর এক পুলিশ এসে আহমদ আলীকে একখানা চিঠি দিয়ে গেল। তিনি সেটা পড়েন আর হাসেন। তারপর তিনি রিপোর্টখানা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। তাতে রয়েছে আমার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, এবং বিশেষ করে জোর দেওয়া হয়েছে যে লোকটা বাঙালী আহমদ আলী যেন উক্ত লোকটার অনুসন্ধান করে সদাশয় সরকারকে তার হাল-হকিকৎ বালান।
আহমদ আলী কাগজের তলায় লিখলেন, এলো আমার অতিথি।
আমি বললুম, নাম-ধাম মতলবটাও লিখে দিন— জানতে চেয়েছে যে।
আহমদ আলী বলেন, কী আশ্চর্য, অতিথির পিছনেও গোয়েন্দাগিরি করব নাকি?
আমি ভাবলুম পাঠানমুল্লুকে কিঞ্চিৎ বিদ্যা ফলাই। বললুম, কর্ম করে যাবেন নিরাসক্ত ভাবে, তাতে অতিথির লাভলোকসানের কথা উঠবে না, এই হল গীতার আদেশ।
আহমদ আলী বললেন, হিন্দুধর্মে শুনতে পাই অনেক কেতাব আছে। তবে আপনি বেছে বেছে একখানা গীতের বই থেকে উপদেশটা ছাড়লেন কেন? তা সে কথা থাক। আমি বিশ্বাস করি কোনো কর্ম না করাতে, সে আসক্তই হোক আর নিরাসক্তই হোক। আমার ধর্ম হচ্ছে উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা।
উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা কথাটায় আমার মনে একটু ধোঁকা লাগল। আমরা বলি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকব এবং এই রকম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকাটা ইংরেজ পছন্দ করে না বলে লাই পাইন কর্মটি প্রভুদের পক্ষে অপকর্ম বলে গণ্য হয়। পাঠানে ইংরেজে মিল আছে পূর্বেই বলেছি, ভাবলুম তাই বোধ হয় পাপটা এড়াবার ও আরামটি বজায় রাখার জন্য পাঠান উবুড় হয়ে শুয়ে থাকার কথাটা আবিষ্কার করেছে।
আমার মনে তখন কি দ্বিধা আহমদ আলী আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কি না জানিনে। নিজের থেকেই বললেন, তা না হলে এদেশে রক্ষা আছে! এই তো মাত্র সেদিনের কথা। রাত্রে বেরিয়েছি রোদে–মশহুর নাচনেওয়ালী জাকী বাঈ কয়েক দিন ধরে গুম, যদি কোনো পাত্তা মেলে। আমি তো আপন মনে হেঁটে যাচ্ছি আমার প্রায় পঞ্চাশ গজ সামনে জন আষ্টেক গোরা সেপাই কঁধ মিলিয়ে রাত্তিরের টহলে কদম কদম এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একসঙ্গে এক লহমায় অনেকগুলো রাইফেলের কড়াক্-পি। আমিও তড়াক করে লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লুম, তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে পাশের নর্দমায়। সেখানে উবুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে মাথা তুলে দেখি, গোরার বাচ্চারা সব মাটিতে লুটিয়ে, জন দশেক আফ্রিদী চটপটু গোরাদের রাইফেলগুলো তুলে নিয়ে অন্তর্ধান। আফ্রিদীর নিশান সাক্ষাৎ যমদূতের ফরমান, মকমল ডিক্রি, কিস্তি বরখেলাপের কথাই ওঠে না।
তাই বলি, উবুড় হয়ে শুয়ে থাকতে না জানলে কখন যে কোন্ আফ্রিদীর নজরে পড়ে যাবেন বলা যায় না। জান বাঁচাবার এই হল পয়লা নম্বরের তালিম।
আমি বললুম, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলেই বা দোষ কি?
আহমদ আলী বললেন, উহু, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে দেখতে পাবেন খুদাতালার আসমান সে বড় খাবসুরৎ। কিন্তু মানুষের বদমায়েশীর উপর নজর রাখবেন কি করে? কি করে জানবেন যে ডেরা ভাঙবার সময় হল, আর এখানে শুয়ে থাকলে নয়া ফ্যাসাদে বাঁধা পড়ার সম্ভাবনা? মিলিটারি আসবে, তদারকতদন্ত হবে, আপনাকে পাকড়ে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে আফ্রিদীর গুলী ভালো।