ফিরিঙ্গী হোক, সায়েব হোক, তবু তে কলকাতার লোক— তালতলার লোক। ঐ তালতলাতেই ইরানী হোটেলে কতদিন খেয়েছি, হিন্দু বন্ধুদের মোগলাই খানার কায়দাকানুন শিখিয়েছি, স্কোয়ারের পুকুরপাড়ে বসে সাঁতার কাটা দেখেছি, গোরা সেপাই আর ফিরিঙ্গীতে মেম সায়েব নিয়ে হাতাহাতিতে হাততালি দিয়েছি।
আর বাড়িয়ে বলব না। এই তালতলারই আমার এক দার্শনিক বন্ধু একদিন বলেছিলেন যে এমেটিন ইনজেকশন নিলে মানুষ নাকি হঠাৎ অত্যন্ত স্যাঁৎসেঁতে হয়ে যায়, ইংরিজীতে যাকে বলে ‘মডলিন’–তখন নাকি পাশের বাড়ির বিড়াল মারা গেলে মানুষ বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বিদেশে যাওয়া আর এমেটিন ইনজেকশন নেওয়া প্রায় একই জিনিষ। কিন্তু উপস্থিত সে গবেষণা থাক— ভবিষ্যতে যে তার বিস্তর যোগাযোগ হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ভোর কোথায় হল মনে নেই। জুন মাসের গরম পশ্চিমে গৌরচন্দ্রিকা করে মামে না। সাতটা বাজতে না বাজতেই চড়চড় করে টেরচা হয়ে গাড়িতে ঢোকে আর বাকি দিনটা কি রকম করে কাটবে তার আভাস তখনই দিয়ে দেয়। শুনেছি পশ্চিমের ওস্তাদরা নাকি বিলম্বিত একতালে বেশীক্ষণ গান গাওয়া পছন্দ করেন না, দ্রুত তেলেই তাঁদের কালোয়াতি দেখানোর শখ। আরো শুনেছি যে আমাদের দেশের রাগরাগিণী নাকি প্রহর আর ঋতুর বাছবিচার করে গাওয়া হয়। সেদিন সন্ধ্যায় আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে পশ্চিমের সকাল বেলাকার রোর বিলম্বিত আর বাদবাকি দিন দ্রুত।
গাড়ি যেন কালোয়াৎ। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে, কোনো গতিকে রোদ্দুরের তবলচীকে হার মানিয়ে যেন কোথাও গিয়ে ঠাণ্ডায় জিরোবে। আর রোদ্দরও চলেছে সঙ্গে সঙ্গে ততোধিক ঊর্ধ্বশ্বাসে। সে পাল্লায় প্যাসেঞ্জারদের প্রাণ যায়। ইস্টিশানে ইস্টিশানে সম। কিন্তু গাড়ি থেকেই দেখতে পাই রোদ্দুর প্ল্যাটফর্মের ছাওয়ার বাইরে আড়নয়নে গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে— বাঘা তবলচী যে রকম দুই গানের মাঝখানে বায়া-তবলার পিছনে ঘাপটি মেরে চাটিম চাটিম বোল তোলে আর বাঁকা নয়নে ওস্তাদের পানে তাকায়।
কখন খেয়েছি, কখন ঘুমিয়েছি, কোন্ কোন্ ইস্টিশান গেল, কে গেল না তার হিসেব রাখিনি। সে গরমে নেশা ছিল, তা না হলে কবিতা লিখব কেন? বিবেচনা করুন–
দেখিলাম পোড়। মাঠ। যতদূর দিগন্তের পানে
দৃষ্টি যায় দগ্ধ, ক্ষুব্ধ ব্যাকুলতা। শান্তি নাহি প্রাণে
ধরিত্রীর কোনোখানে। সবিতার ক্রুদ্ধ অগ্নিদৃষ্টি
বর্ষিছে নির্মম বেগে। গুমরি উঠিছে সর্বসৃষ্টি
অরণ্য পর্বত জনপদে। যমুনার শুষ্ক বক্ষ
এ তীর ও তীর ব্যাপী— শুষিয়াছে কোন ক্রুর যক্ষ
তার স্নিগ্ধ মাতৃস। হাহাকার উঠে সর্বনাশা
চরাচরে। মনে হয় নাই নাই নাই কোনো আশা
এ মরুরে প্রাণ দিতে সুধা-সিক্ত শ্যামলিম ধারে।
বৃত্রের জিঘাংসা আজ পর্জস্যের সর্বশক্তি কাড়ে বা
সব আসবরিক্ত। ধরণীর শুরু স্তনতৃণে
প্রেতযোনি গাভী, বস হৃত-আশ ক্লান্ত টেনে টেনে।
কী কবিতা! পশ্চিমের মাঠের চেয়েও নীরস কর্কশ। গুরুদেব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এ-পদ্য ছাপানো হয় নি। গুরুশাপ ব্ৰহ্মশাপ।
০৩. সর্দারজী যখন চুল বাঁধতে
সর্দারজী যখন চুল বাঁধতে, দাড়ি সাজাতে আর পাগড়ি পাকাতে আরম্ভ করলেন তখনই বুঝতে পারলুম যে পেশাওয়ার পৌঁছতে আর মাত্র ঘণ্টাখানেক বাকি। গরমে, ধুলোয়, কয়লার গুড়োয়, কাবাবরুটিতে আর স্নানাভাবে আমার গায়ে তখন আর একরত্তি শক্তি নেই যে বিছানা গুটিয়ে হোন্ডল বন্ধ করি। কিন্তু পাঠানের সঙ্গে ভ্রমণ করাতে সুখ এই যে, আমাদের কাছে যে কাজ কঠিন বলে বোধ হয় পাঠান সেটা গায়ে পড়ে করে দেয়। গাড়ির ঝাঁকুনির তাল সামলে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, উপরের বাঙ্কের বিছানা বাঁধা আর দেশলাইটি এগিয়ে দেওয়ার মধ্যে পাঠান কোনো তফাৎ দেখতে পায় না। বাক্স তোরঙ্গ নাড়াচাড়া করে যেন অ্যাটাচি কেস।
ইতিমধ্যে গল্পের ভিতর দিয়ে খবর পেয়ে গিয়েছি যে পাঠানমুল্লুকের প্রবাদ, দিনের বেলা পেশাওয়ার ইংরেজের, রাত্রে পাঠানের। শুনে গর্ব অনুভব করেছি বটে যে বন্দুকধারী পাঠান কামানধারী ইংরেজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কিন্তু বিন্দুমাত্র আরাম বোধ করিনি। গাড়ি পেশাওয়ার পৌঁছবে রাত নটায়। তখন যে কার রাজত্বে গিয়ে পৌঁছব তাই নিয়ে মনে মনে নানা ভাবনা ভাবছি এমন সময় দেখি গাড়ি এসে পেশাওয়ারেই দাঁড়াল। বাইরে ঠা ঠা আলল, নটা বাজল কি করে, আর পেশাওয়ারে পৌঁছলুমই বা কি করে? একটানা মুসাফিরির ধাক্কায় মন তখন এমনি বিকল হয়ে গিয়েছিল যে শেষের দিকে ঘড়ির পানে তাকানো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলুম। এখন চেয়ে দেখি সত্যি নটা বেজেছে। তখন অবশ্য এসব ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে হয়রান হবার ফুরসৎ ছিল না, পরে বুঝতে পারলুম পেশাওয়ার এলাহাবাদের ঘড়িমাফিক চলে বলে কাটা খুবই স্বাভাবিক ও বৈজ্ঞানিক তখন আবার জুন মাস।
প্ল্যাটফরমে বেশী ভিড় নেই। জিনিসপত্র নামাবার ফাঁকে লক্ষ্য করলুম যে ছফুটী পাঠানদের চেয়েও একমাথা উঁচু এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। কাতর নয়নে তার দিকে তাকিয়ে যতদূর সম্ভব নিজের বাঙালিত্ব জাহির করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এসে উত্তম উছুতে আমাকে বললেন, তাঁর নাম শেখ আহমদ আলী। আমি নিজের নাম বলে একহাত এগিয়ে দিতেই তিনি তার দুহাতে সেটি লুফে নিয়ে দিলেন এক চাপ–পরম উৎসাহে, গরম সম্বর্ধনায়। সে চাপে আমার হাতের পাঁচ আঙুল তার দুই থাবার ভিতর তখন লুকোচুরি খেলছে। চিৎকার করে যে লাফ দিয়ে উঠিনি তার একমাত্র কারণ বোধহয় এই যে তখন গাড়ির পাঠানের দুটো আঙুল উড়ে যাওয়ার গল্প অবচেতন মনে বাসা বেঁধে অর্ধচেতন সহিষ্ণুতায় আমাকে উৎসাহিত করছিল। তাই সেদিন পাঠানমুল্লুকের পয়লা কেলেঙ্কারি থেকে বাঙালী নিজের ইজ্জৎ বাঁচাতে পারল। কিন্তু হাতখানা কোন্ শুভলগ্নে ফেরৎ পাব সে কথা যখন ভাবছি তখন তিনি হঠাৎ আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে খাস পাঠানী কায়দায় আলিঙ্গন করতে আরম্ভ করেছেন। তার সমানে সমান উঁচু হলে সেদিন কি হত বলতে পারিনে কিন্তু আমার মাথা তার বুক অবধি পোঁছয়নি বলে তিনি তার এক কড়া জোরও আমার গায়ে চাপাতে পারছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উছু পশতুতে মিলিয়ে যা বলে যাচ্ছিলেন তার অনুবাদ করলে অনেকটা দাঁড়ায় ভালো আছেন তো, মঙ্গল তো, সব ঠিক তো, বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েননি তো? আমি জী হাঁ, জী না, করেই যাচ্ছি আর ভাবছি গাড়িতে পাঠানদের কাছ থেকে তাদের আদবকায়দা কিছুটা শিখে নিলে ভালো করতুম। পরে ওয়াকিফহাল হয়ে জানলুম, বন্ধুদর্শনে এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই, দেওয়া কায়দা নয়। উভয় পক্ষ একসঙ্গে প্রশ্নের ফিরিস্তি আউড়ে যাবেন অন্ততঃ দুমিনিট ধরে। তারপর হাতমিলানা, বুক-মিলানা শেষ হলে একজন একটি প্রশ্ন শুধাবেন, কি রকম আছেন? আপনি তখন বলবেন, শুকুর, অহমদুলিল্লা অর্থাৎ খুদাতালাকে ধন্যবাদ, আপনি কি রকম? তিনি বলবেন, শুকুর, অহমদুলিল্লা। সর্দিকাশির কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে হলে তখন বলতে পারেন কিন্তু মিলনের প্রথম ধাক্কায় প্রশ্নতরঙ্গের উত্তর নানা ভঙ্গিতে দিতে যাওয়া সখ্ৎ বেয়াদবী!