আমি বললুম, বুলেট ছাড়া অন্য নানা কায়দায়ও তো মানুষ মরতে পারে। জ্বর আছে, কলেরা আছে, সান্নিপাতিক আছে, আর না খেয়ে মরার রাজকীয় পন্থা তো বারোমাসই খোলা রয়েছে। সে পথ ধরলে দু-দণ্ড জিরোবার তরে সরাই-ই বলুন, আর হাসপাতালই বলুন কোনো কিছুরই বালাই নেই।
বেতারবাণী হলনা খেয়ে মরতে পারাটা তামাম প্রাচ্যভূমির অনবদ্য প্রতিষ্ঠান। একে অজরামর করে রাখার নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টার নামান্তর হোয়াইট মেনস বার্ডেন। কিন্তু আফগানরা প্রাচ্যভূমির ছোটজাত বলে নিজের মোট নিজেই বইবার চেষ্টা করে। সাধারণত এই মোট নিয়ে প্রথম কাড়াকাড়ি লাগায় ধর্মপ্রাণ মিশনরীরা, তাই আফগানিস্থানে তাদের ঢোকা কড়া বারণ। কোনো অবস্থাতেই কোনো মিশনরীকে পাসপোর্ট দেওয়া হয় না। মিশনরীর পরে আসে ইংরেজ। তাদেরও আমরা পারতপক্ষে ঢুকতে দিই না–ব্রিটিশ রাজদূতাবাসের জন্য যে কজন ইংরেজের নিতান্ত প্রয়োজন তাদেরি আমরা বড় অনিচ্ছায় বরদাস্ত করেছি।
এই দুটি খবর আমার কর্ণকুহরে মথি ও মার্ক লিখিত দুই সুসমাচারের ন্যায় মধুসিঞ্চন করল। গুলিস্তান, বোস্তানের খুশবাই হয়ে সকল দুর্গন্ধ মেরে ফেলে আমার চোখে গোলাপী ঘুমের মোলায়েম তন্দ্রা এনে দিল।
জিন্দাবাদ আফগানিস্থান। না হয় থাকলই বা লক্ষ লক্ষ ছারপোকা সে দেশের চারপাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে জিন্দা হয়ে।
১০. সব কিছু পণ্ড না হলে পণ্ডিত হয় না
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল আজান শুনে। নমাজ পড়ালেন বুখারার এক পুস্তিন সদাগর। উৎকৃষ্ট আরবী উচ্চারণ শুনে বিস্ময় মানলুম যে তুর্কীস্থানে এত ভালো উচ্চারণ টিকে রইল কি করে। বেতারওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন না। আমি বললুম, কিছু যদি মনে করেন? আমার এই সঙ্কোচে তিনি এত আশ্চর্য হলেন যে বুঝতে পারলুম, খাস প্রাচ্য দেশে অচেনা অজানা লোককে যে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বাধা নেই। পরে জানলুম, যার সম্বন্ধে কৌতূহল দেখানো হয় সে তাতে বরঞ্চ খুশীই হয়।
মোটরে বসে তারি খেই তুলে নিয়ে আগের রাতের অভিজ্ঞতার জমাখরচা নিতে লাগলুম।
গ্রেট ইস্টার্ন পান্থশালা, আফগান সরাইও পান্থশালা। সরাইয়ের আরাম-ব্যারাম তো দেখা হল— গ্রেট ইস্টার্ন, গ্র্যাণ্ডেরও খবর কিছু কিছু জানা আছে।
মার্কস না পড়েও চোখে পড়ে যে সরাই গরীব, হোটেল ধনী। কিন্তু প্রশ্ন তাই দিয়ে কি সব পার্থক্যের অর্থ করা যায়? সরাইয়েও জন আষ্টেক এমন সদাগর ছিলেন যারা অনায়াসে গ্রেট ইস্টার্নের সুইট নিতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারি হয়েছে। গ্রেট ইস্টার্নের বড়সায়েবদেরও কিছু কিছু চিনি।
কিন্তু আচারব্যবহারে কী ভয়ঙ্কর তফাত। এই আটজন ধনী সদাগর ইচ্ছে করলেই একত্র হয়ে উত্তম খানাপিনা করে জুয়োয় দু শ চার শ টাকা এদিক ওদিকে ছড়িয়ে দিয়ে রাত কাটাতে পারতেন। চাকরবাকর সন্ত্রস্ত হয়ে হুজুরদের হুকুম তামিল করত— সরাইয়ের ভিখিরি ফকিরদের তল ঠেকিয়ে রাখতই, সাধুসজ্জনদের সঙ্গেও এদের কোনো যোগাযোগ হত না।
পৃথক হয়ে আপন আপন দ্বিরদরদস্তম্ভে এরা তো বসে থাকলেনই না— আটজনে মিলে খানদানী গোঠও এরা পাকালেন না। নিজ নিজ পণ্যবাহিনীর ধনী গরীব আর পাঁচজনের সঙ্গে এদের দহরম-মহরম আগের থেকে তো ছিলই, তার উপরে সরাইয়ে আসন পেতে জিরিয়েজুরিয়ে নেওয়ার পর তারা আরো পাঁচজনের তত্ত্বতাবাশ করতে আরম্ভ করলেন। তার ফলে হরেক রকমের আজ্ঞা জমে উঠল; ধনী গরীবের পার্থক্য জামা কাপড়ে টিকে থাকল বটে কিন্তু কথাবার্তায় সে সব তফাত রইল না। দু-চারটে মোসাহেব ইয়েমেন ছিল সন্দেহ নেই, তা সে গরীব আড্ডা-সর্দারেরও থাকে। ব্যবসাবাণিজ্য, তত্ত্বকথা, দেশ-বিদেশের রাস্তাঘাট-গিরিসঙ্কট, ইংরেজ-রুশের মন-কষাকষি, পাগলা উট কামড়ালে তার দাওয়াই, সর্দারজীর মাথার ছিট, সব জিনিস নিয়েই আলোচনা হল। গরীব ধনী সকলেরই সকল রকম সমস্যা আর দয়ে মজে কখনো ডুবল কখনো ভাসল; কিন্তু বাকচতুর গরীবও ধনীর পোলাও-কালিয়ার আশায় বেশরম বাদরনাচ নাচল না।
ঝগড়া-কাজিয়াও আড়ার চোখের সামনের চাতালে হচ্ছে। কথাবার্তার খোঁচাখুচিতে যতক্ষণ উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট ততক্ষণ আড্ডা সে সব দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না, কিন্তু মারামারির পূর্বাভাস দেখা দিলেই কেউ-না-কেউ মধ্যস্থ হয়ে বখেড়া ফৈালা করে দেয়। মনে পড়ল বায়স্কোপের ছবি : সেখানে দুই সায়েবে ঝগড়া লাগে, আর পাঁচজন হটে গিয়ে জায়গা করে দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়। দুই পায়েব তখন কোট খুলে ছুঁড়ে ফেলেন, আর সকলের দয়ার শরীর, কোটটাকে ধুলোয় গড়াতে দেন না, লুফে নেন। তারপর শুরু হয় ঘুষোঘুষি রক্তারক্তি। পাঁচজন বিনা টিকিটে তামাসা দেখে আর সমস্ত বর্বরতাটাকে অন্য লোকের নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার নাম দিয়ে ক্ষীণ বিবেকদংশনে প্রলেপ লাগায়।
সরাইয়ে কারো কোনো নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার নেই। তাই পার্সোনাল ইডিয়সিংক্রেসি বা খেয়াল খুশীর ছিট নিয়ে কেউ সরাইয়ে আশ্রয় নেয় না। অথবা বলতে পারেন, সকলেই যে যার খুশী মত কাজ করে যাচ্ছে, আপনি আপত্তি জানাতে পারবেন না, আর আপনিও আপনার পছন্দ মত যা খুশী করে যাবেন, কেউ বাধা দেবে না। হাতাহাতি না হলেই হল।
তাতে করে ভালো মন্দ দুই-ই হয়। একদিকে যেমন গরম, ধুলো, তৃষ্ণা সত্ত্বেও মানুষ একে অন্যকে প্রচুর বরদাস্ত করতে পারে, অন্যদিকে তেমনি সকলেই সরাইয়ের কুঠরি-চত্বর নির্মমভাবে নোংরা করে।