তবে একথা ঠিক, দুর্গন্ধ ও নোংরামি সহ্য করে কেউ যদি সরাইয়ে জ্ঞান অন্বেষণ অথবা আড়র সন্ধানে একটা চক্কর লাগায়, তবে তাকে নিরাশ হতে হবে না। আহমদ আলীর ফিরিস্তিমাফিক সব জাত সব ভাষা তো আছেই, তার উপরে গুটিকয়েক সাধুসজ্জন, দু-একজন হজযাত্রী পায়ে চলে মক্কা পৌঁছবার জন্য তাঁরা ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়েছেন। এদের চোখেমুখে কোনো ক্লান্তির চিহ্ন নেই; কারণ এরা চলেন অতি মন্দগতিতে এবং নোংরামি থেকে গা বাঁচাবার কায়দাটা এরা ফ্রন্টিয়ারেই রপ্ত করে নিয়েছেন। সম্বল-সামর্থ্য এদের কিছুই নেই— উপরে আল্লার মরজি ও নিচে মানুষের দাক্ষিণ্য এই দুই-ই তাদের নির্ভর।
অনৈসর্গিক পাপের আভাস ইঙ্গিতও আছে কিন্তু সেগুলো হির্শফেলটু সায়েবের জিম্মাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সেই সাত-সকালে পেশাওয়ারে আণ্ডা-রুটি খেয়ে বেরিয়েছিলুম তারপর পেটে আর কিছু পড়েনি। দক্কার শরবৎ পেট পর্যন্ত পৌঁছয়নি, শুকনো তালু-গলাই তাকে শুষে নিয়েছিল। কিন্তু চতুর্দিকের নোংরামিতে এমনি গা ঘিন ঘিন করছিল যে, কোনো কিছু গিলবার প্রবৃত্তি ছিল না। নিজের আধিক্যেতায় নিজের উপর বিরক্তিও ধরছিল–আরে বাপু, আর পাঁচজন যখন দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুমচ্ছে, তখন তুমিই বা এমন কোন্ নবাব খাঞ্জা খাঁর নাতি যে, তোমার স্নান না হলে চলে না, মাত্র দুহাজার বছরের জমানো গন্ধে তুমি ভিরমি যাও। তবু তো জানোয়ারগুলো চত্বরে, তুমি বারান্দার শুয়ে। মা জননী মেরী সরাইয়েও জায়গা পাননি বলে শেষটায় গাধা-খচ্চরের মাঝখানে প্রভু যীশুর জন্ম দেন নি? ছবিতে অবশ্য সায়েব বোরা যতদূর সম্ভব সাফসুতরো করে সব কিছু একেছেন, কিন্তু শাকে ঢাকা পড়ে কটা মাছ।
বেৎলেহেমের সরাইয়ে আর আফগানিস্থানের সরাইয়ে কি তফাত। বেৎলেহেমেও বৃষ্টি হয় তিন ফোঁটা আর বরফ পড়ে আড়াই তোলা। কে বললে তোমায় ইহুদি আফগানের চেয়ে পরিষ্কার? আফগানিস্থানের গন্ধে তোমার গা বিড়োচ্ছ, কিন্তু ইহুদির গায়ের গন্ধে বোকা পাঁঠা পর্যন্ত লাফ দিয়ে দরমা ফুটো করে প্রাণ বাঁচায়।
এ সব হল তত্ত্বজ্ঞানের কথা। কিন্তু মানুষের মনের ভিতর যে রকম গীতাপাঠ হয়, সে রকম বেয়াড়া দুর্যোধনও সেখানে বসে। তার শুধু এক উত্তর, জানামি ধর্মং, ন চ মে প্রবৃত্তি, অর্থাৎ তত্ত্বকথা আর নূতন শোনাচ্ছ কি, কিন্তু ওসবে আমার প্রবৃত্তি নেই। তার উপর আমার বেয়াড়া মনের হাতে আরেকখানা খাসা উত্তরও ছিল। সর্দারজী ও বনেটবাসিনীতে যদি সঁঝের ঝোঁকে ঢলাঢলি আরম্ভ না হত তবে অনেক আগেই জলালাবাদের সরকারী ডাকবাঙলোয় পৌঁছে সেখানে তোমাতে-আমাতে স্নানাহার করে এতক্ষণে নরগিস ফুলের বিছানায়, চিনার গাছের দোদুল হাওয়ায় মনের হরিষে নিদ্রা যেতুম না?
বেয়াড়া মন কিছু কিছু তত্ত্বজ্ঞানেরও সন্ধান রাখে না হলে বিবেকবুদ্ধির সঙ্গে এক ঘরে সারাজীবন কাটায় কি করে? ফিস ফিস করে তর্কও জুড়ে দিয়ে বলল, মা মেরী ও যীশুর যে গল্প বললে সে হল বাইবেলি কেচ্ছ। মুসলমান শাস্ত্রে আছে, বিবি মরিয়ম (মেরী) খেজুরগাছের তলায় ইসা-মসীহকে প্রসব করেছিলেন।
বিবেকবুদ্ধি–সে কি কথা! ডিসেম্বরের শীতে মা মেরী গেলেন গাছতলায়?
বেয়াড়া মন কেন বাপু, তোমার বাইবেলেই তো রয়েছে, প্রভু জন্মগ্রহণ করলে পর দেবদূতেরা সেই সুসমাচার মাঠের মাঝখানে গয়ে রাখাল ছেলেদের জানালেন। গয়লার ছেলে যদি শীতের রাত মাঠে কাটাতে পারে, তবে ছুতোরের বউই পারবে না কেন, শুনি? তার উপর গর্ভযন্ত্রণা সর্বাঙ্গে তখন গল গল করে ঘাম ছোটে।
ধর্ম নিয়ে তর্কাতর্কি আমি আদপেই পছন্দ করিনে। দুজনকে দুই ধমক দিয়ে চোখ বন্ধ করলুম।
চত্বরের ঠিক মাঝখানে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত উঁচু একটা প্রহরী শিখর। সেখান থেকে হঠাৎ এক হুঙ্কারধ্বনি নির্গত হয়ে আমার তন্দ্রাভঙ্গ করল। শিখরের চূড়ো থেকে সরাইওয়ালা চেঁচিয়ে বলছিল, সরাই যদি রাত্রিকালে দস্যুদ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে হে যাত্রীদল, আপন আপন মালজান বাঁচাবার জিম্মাদারি তোমাদের নিজের।
ঐটুকুই বাকি ছিল। সরাইয়ের সব কষ্ট চাঁদপানা মুখ করে সয়ে নিয়েছিলুম ঐ জানটুকু বাঁচাবার আশায়। সরাইওয়ালা সেই জিম্মাদারিটুকুও আমার হাতে ছেড়ে দেওয়ায় যখন আর কোনো ভরসা কোনো দিকে রইল না, তখন আমার মনে এক অদ্ভুত শান্তি আর সাহস দেখা দিল। উর্দুতে বলে, নঙ্গেসে খুদাভী ডরতে হ্যায় অর্থাৎ উলঙ্গকে ভগবান পর্যন্ত সমঝে চলেন। সোজা বাঙলায় প্রবাদটা সামান্য অন্যরূপ নিয়ে অল্প একটু গীতিরসে ভেজা হয়ে বেরিয়েছে, সমুদ্রে শয়ন যার শিশিরে কি ভয় তার?
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে আমার মনে তখন আরও একটা খটকা লাগল। রেডিয়োওয়ালার চোস্ত ফার্সী জানার কথা। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ঐ যে সরাইওয়ালা বলল, মাল-জানের তদারকি আপন আপন কাঁধে এ কথাটা আমার কানে কেমনতরো নুতন ঠেকলো। সমাসটা কি জান-মাল নয়?
অন্ধকারে রেডিয়োওয়ালার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তাই তার কথা অনেকটা বেতারবার্তার মত কানে এসে পৌঁছল। বললেন, ইরানদেশের ফার্সীতে বলে, জান-মাল কিন্তু আফগানিস্থানে জান সস্তা, মালের দাম ঢের বেশী। তাই বলে মালজান।
আমি বললুম, তাই বোধ করি হবে। ভারতবর্ষেও প্রাণ বেজায় সস্তা—তাই আমরাও বলি, ধনে-প্রাণে মেরো না। প্রাণে-ধনে মেরো না কথাটা কখনো শুনিনি।
আমাতে বেতারওয়ালাতে তখন একটা ছোটখাটো ব্রেন-ট্রাস্ট বানিয়ে বসেছি। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ফ্রন্টিয়ারের ওপারে তো শুনেছি জীবন পদে পদে বিশেষ বিপন্ন হয় না। তবে আপনার মুখে এরকম কথা কেন?