আমার কি মনে হয় জানেন? বুড়ী মরে গিয়েছে। মোটরের বনেট খুলতে পেলে সে এখন বউয়ের ঘোমটা খোলার আনন্দ পায়। নূতন গাড়িতে তার অজুহাত কোথায়?
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, বউয়ের ঘোমটা খোলার জন্য আবার অজুহাতের প্রয়োজন হয় নাকি?
অফিসার বললেন, হয়, হয়। রাজাধিরাজের বেলাও হয়। শুনুন, কাবুল-বদখশান আধা হিন্দুস্থানের মালিক হুমায়ুন বাদশা জুবেদীকে কি বলেছেন–
তবু যদি সাধি তোমা ভিখারীর মত
দেখা মোরে দিতে করুণায়;
বল তুমি, রহি অবগুণ্ঠনের মাঝে
এ-রূপ দেখাতে নারি হায়।
তৃষা আর তৃপ্তি মাঝে রবে ব্যবধান
অর্থহীন এ অবগুণ্ঠন?
আমার আনন্দ হতে সৌন্দর্য তোমার
দূরে রাখে কোন্ আবরণ।
একি গো সমরলীলা তোমায় আমায়?
ক্ষমা দাও, মাগি পরিহার;
মরমের মর্ম যাহা তাই তুমি মোর
জীবনের জীবন আমার।
-সত্যেন দত্তের অনুবাদ
৯. আফগানিস্থানের অফিসার যদি কবি হতে পারেন
আফগানিস্থানের অফিসার যদি কবি হতে পারেন, তবে তার পক্ষে পীর হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। তিন তিনবার চাকা ফাটল, আর এঞ্জিন সর্দারজীর উপর গোসা করে দুবার গুম হলেন। চাকা সারাল হ্যাণ্ডিম্যান–তদারক করলেন সর্দারজী। প্রচুর মেহদি-প্রলেপের সলুশন লাগিয়ে বিবিজানের কদম মবারক মেরামত করা হল, কিন্তু তার মুখ ফোঁটাবার জন্য স্বয়ং সর্দারজীকে ওড়না তুলে অনেক কাকুতিমিনতি করতে হল। একবার চটে গিয়ে তিনি হ্যাণ্ডিল মারার ভয়ও দেখিয়েছিলেন–শেষটায় কোন্ শর্তে রফারফি হল, তার খবর আমরা পাইনি বটে, কিন্তু হরেকরকম আওয়াজ থেকে আমেজ পেলুম বিবিজান অনিচ্ছায় শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন।
জালালাবাদ পৌঁছবার কয়েক মাইল আগে তার কোমরবন্ধ অথবা নীবিবন্ধ, কিম্বা বেল্ট যাই বলুন, ছিঁড়ে দুটুকরো হল। তখন খবর পেলুম সর্দারজীও রাতকানা। রেডিয়োর কর্মচারী আমার কানটাকে মাইক্রোফোন ভেবে ফিস ফিস করে প্রচার করে দিলেন, অদ্যকার মত আমাদের অনুষ্ঠান এইখানেই সমাপ্ত হল। কাল সকালে সাতটায় আমরা আবার উপস্থিত হব।
আধ মাইলটাক দূরে আফগান সরাই। বেতারের সায়েব ও আমি আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে চললুম। বাদবাকি আর সকলে হৈ-হল্লা করে করে গাড়ি ঠেলে নিয়ে চলল। বুঝলুম, এদেশেও বাস চড়ার পূর্বে সাদা কালিতে কাবিননামায় লিখে দিতে হয়, বিবিজানের খুশীগমীতে তাঁহাকে স্বহস্তে স্বস্কন্ধে ঠেলিয়া লইয়া যাইতে গররাজি হইব না।
সর্দারজী তন্বী করে বললেন, একটু পা চালিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে সরাইয়ের দরজা বন্ধ করে দেবে।
সরাই তো নয়, ভীষণ দুশমনের মত দাঁড়িয়ে এক চৌকো দুর্গ। কর্মঅন্তে নিভৃত পান্থশালাতে বলতে আমাদের চোখে যে স্নিগ্ধতার ছবি ফুটে ওঠে এর সঙ্গে তার কোনো সংস্রব নেই। ত্রিশ ফুট উঁচু হলদে মাটির নিরেট চারখানা দেয়াল, সামনের খানাতে এক বিরাট দরজা— তার ভিতর দিয়ে উট, বাস, ডবল-ডেকার পর্যন্ত অনায়াসে ঢুকতে পারে, কিন্তু ভিতরে যাবার সময় মনে হয়, এই শেষ ঢোকা, এ দানবের পেট থেকে আর বেরতে হবে না।
ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম। কত শত শতাব্দীর পুঞ্জীভূত দুর্গন্ধ আমাকে ধাক্কা মেরেছিল বলতে পারিনে, কিন্তু মনে হল আমি যেন সে ধাক্কায় তিন গজ পিছিয়ে গেলুম। ব্যাপারটা কি বুঝতে অবশ্য বেশী সময় লাগল না। এলাকাটা মৌসুমী হাওয়ার বাইরে, তাই এখানে কখনো বৃষ্টি হয় না— যথেষ্ট উঁচু নয় বলে বরফও পড়ে না। আশেপাশে নদী বা ঝরনা নেই বলে ধোয়ামোছর জন্য জলের বাজে খরচার কথাও ওঠে না। অতএব সিকন্দরশাহী বাজীরাজ থেকে আরম্ভ করে পরশুদিনের আস্ত ভেড়ার পাল যে সব অবদান রেখে গিয়েছে, তার স্থূলভাগ মাঝে মাঝে সাফ করা হয়েছে বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম গন্ধ সর্বত্র এমনি স্তরীভূত হয়ে আছে যে, ভয় হয় ধাক্কা দিয়ে না সরালে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব; ইচ্ছে করলে চামচ দিয়ে কুরে কুরে তোল যায়। চতুর্দিকে উঁচু দেয়াল, মাত্র একদিকে একখানা দরজা। বাইরের হাওয়া তারি সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়, অন্যদিকে বেরবার পথ নেই দেখে ঐ জালিয়ানওয়ালাবাগে আর ঢোকে না। সূচীভেদ্য অন্ধকার দেখেছি, এই প্রথম সূচীভেদ্য দুর্গন্ধ শুকলুম।
দুর্গকারকে পিছনের দেয়ালস্বরূপ ব্যবহার করে চার সারি কুঠরি নয়–খোপ। শুধু দরজার জায়গাটা ফাঁকা। খোপগুলোর তিন দিক বন্ধ— সামনের চত্বরের দিক খোলা। বেতারওয়ালা সরাইয়ের মালিকের সঙ্গে দর-কষাকষি করে আমাদের জন্য একটা খোপ ভাড়া নিলেন আমার জন্য একখানা দড়ির চারপাইও যোগাড় করা হল। খোপের সামনের দিকে একটু বারান্দা, চারপাই সেখানে পাতা হল। খোপের ভিতর একবার এক লহমার তরে ঢুকেছিলুম মানুষের কত কুবুদ্ধিই না হয়। ধর্ম সাক্ষী, স্মেলিং সল্টে যার ভিরমি কাটে না, তাকে আধ মিনিট সেখানে রাখলে আর দেখতে হবে না।
কেরোসিন কুপির ক্ষীণ আলোকে যাত্রীরা আপন আপন জানোয়ারের তদারক করছে। উট যদি তাড়া খেয়ে পিছু হটতে আরম্ভ করল, তবে খচ্চরের পাল চিৎকার করে রুটিওয়ালার বারান্দায় ওঠে আর কি। মোটর যদি হেডলাইট জ্বালিয়ে রাত্রিবাসের স্থান অনুসন্ধান করে, তবে বাদবাকি জানোয়ার ভয় পেয়ে সব দিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে। মালিকেরা তখন আবার চিৎকার করে আপন আপন জানোয়ার খুঁজতে বেয়োয়। বিচুলি নিয়ে টানাটানি, রুটির দোকানে দর-কষাকষি, মোটর মেরামতের হাতুড়ি পেটা, মোরগ-জবাইয়ের ঘড়ঘড়ানি, আর পাশের খোপের বারান্দায় খান সায়েবের নাক-ডাকানি। তার নাসিকা আর আমার নাকের মাঝখানে তফাত ছয় ইঞ্চি। শিথান বদল করার উপায় নেই— পা তাহলে পশ্চিম দিকে পড়ে ও মুখ উটের নেজের চামর ব্যজন পায়। আর উট যদি পিছু হটতে আরম্ভ করে, তবে কি হয় না-হয় বলা কিছু কঠিন নয়। গোমূত্রের মত পবিত্র জিনিসেও প্রপাতন্নানের ব্যবস্থা নেই।