আমি বললুম, নৌকোতে শুয়ে অনেক রাত কাটিয়েছি।
তিনি উৎসাহের সঙ্গে বললেন, তা হলে আপনি বুঝতে পারবেন। মনে হয় না কুলকুল শুনে, যেন আর দুদিন কাটলেই আরেকটু, আর সামান্য একটু অভ্যাস হয়ে গেলেই হঠাৎ কখন এই রহস্যময়ী ভাষার অর্থ সরল হয়ে যাবে। আপনি ভাবছেন আমি কবিত্ব করছি। আদপেই না। আমার মনে হয় মেঘের ডাক। যেমন জনপ্রাণীকে বিদ্যুতের ভয় জানিয়ে দেয়, জলের ভাষাও তেমনি কোনো এক আশার বাণী জানাতে চায়। দূর সিন্ধুপার থেকে সে বাণী উজিয়ে উজিয়ে এসেছে, না কাবুল পাহাড়ের শিখর থেকে বরফের বুকের ভিতর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এখানে এসে গান গেয়ে জেগে উঠেছে, জানিনে।
এখন বড় গরম। শীতকালে যখন আপনার ছুটি হবে তখন এখানে আসবেন। এই নদীর অনেক গোপন খবর আপনাকে বাৎলে দেব। আহারাদি? কিচ্ছু ভাবনা নেই। মুরগী, দুম্বা যা চাই। শাকসজী? সে গুড়ে পাথর।
অফিসার যখন কথা বলছিলেন, তখন আমার এক একবার সন্দেহ হচ্ছিল, একা থেকে থেকে বোধ হয় ভদ্রলোকের মাথা, কেমন জানি, একটুখানি–। কিন্তু কাবুল নদীর সবুজ আঁচল ছেড়ে তিনি যখন অক্লেশে দুম্বার পিঠে সোওয়ার হলেন, তখনই বুঝলুম ভদ্রলোক সুস্থই আছেন। বললেন, আমার কাজ পাসপোর্ট সই করা আর কি মাল আসছে-যাচ্ছে তার উপর নজর রাখা। কিছু কঠিন কর্ম নয়, বুঝতেই পারছেন। ওদিকে নূতন বাদশা উঠে পড়ে লেগেছেন আফগানিস্থানকে সজীব সবল করে তোলবার জন্য। অনেক লোক তার চারদিকে জড়ো হয়েছেন। শুনতে পাই কাবুলে নাকি সর্বত্র নূতন প্রাণের সবুজ ঘাস জেগে উঠেছে। কিন্তু এদিকে ইংরেজ দুম্বা, ওদিকে রুশী বকরী। সুযোগ পেলেই কঁচা ঘাস সাফ করে দিয়ে কাবুলের নেড়া পাহাড়কে ফের নেড়া করে দেবে। ভাগ্যিস, চতুর্দিকে খোদায় দেওয়া পাথরের বেড়া রয়েছে, তাই রক্ষে। আর রক্ষে এই যে, দুম্বা আর বকরীতে কোনোদিন মনের মিল হয় না। দুম্বা যদি ঘাসের দিকে নজর দেয় তো বকরী শিঙ উঁচিয়ে লাফ দিয়ে আমুদরিয়া পার হতে চায়। বকরী যদি তেড়িমেড়ি করে, তবে দুম্বা ম্যা ম্যা করে আর সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, বকরীর নজর শুধু কাবুলের চাট্টিখানি ঘাসের উপর নয়— তার আসল নজর হিন্দুস্থান, চীন, ইরান সবকটা বড় বড় ধানক্ষেতের উপর।। আমি শুধালুম, দুম্বাটা শুধু শুধু ম্যা ম্যা করবে কেন? তারো তো একজোড়া খাসা শিঙ আছে।
ছিল। হিন্দুস্থান ভাবে, এখনো আছে, কিন্তু এদেশের পাথরে খামকা গুতিয়ে গুতিয়ে ভোতা করে ফেলেছে। তাই বোধ হয় সেটা ঢাকবার জন্য সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়েছে— গোরা সেপাইয়ের খানাপিনার জমক-জৌলুস দেখেছেন তো? হিন্দুস্থান সেই সোনালী শিঙের ঝলমলানি দেখে আরো বেশি ভয় পায়। ওদিকে মিশরে সাদ জগলুল পাশা, তুর্কীতে মুস্তফা কামাল পাশা, হিজাজে ইবনে সউদ, আফগানিস্থানে আমান উল্লা খান দুম্বার পিঠে কয়েকটা আচ্ছা ডাণ্ডা বুলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো জানোয়ারই সহজে ঘায়েল হয় না। জানোয়ার তোর।
আমি আঁৎকে উঠলুম। কী ভয়ঙ্কর সিভিশন। নাঃ, তা তো নয়। মনেই ছিল না যে স্বাধীন আফগানিস্থানে বসে কথা কইছি।
অফিসার বলে যেতে লাগলেন, তাই আজ হিন্দুস্থান আফগানিস্থানে মিলে মিশে যে কাজ করতে যাচ্ছে সে বড় খুশীর কথা। কিন্তু আপনাকে বহুৎ তকলিফ বরদাস্ত করতে হবে। কাবুল শক্ত জায়গা। শহরের চারিদিকে পাথর, মানুষের দিলের ভিতর আরো শক্ত পাথর। শাহানশা বাদশা সেই পাথরের ফাটলে ঘাস গজাচ্ছেন, আপনাকে পানি ঢালতে ডেকেছেন।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, লজ্জা দেবেন না। আমার কাজ অতি নগণ্য।
অফিসার বললেন, তার হিসেবনিকেশ আর-একদিন হবে। আজ আমি খুশী যে এতদিন শুধু পেশাওয়ার পাঞ্জাবের লোক আফগানিস্থানে আসত, এখন দূর বাঙলা মুলুকেও আফগানিস্থানের ডাক পোঁচেছে।।
দেখি সর্দারজী দূর থেকে ইশারায় জানাচ্ছেন, সব তৈরী আমি এলেই মোটর ছাড়ে।
অফিসার সর্দারজীকে দেখে বললেন, অমর সিং বুলানীর গাড়িতে যাচ্ছেন বুঝি? ওর মত হুশিয়ার আর কলকজায় ওস্তাদ ড্রাইভার এ রাস্তায় আর কেউ নেই। এমন গাড়িও নেই যার গায়ে অমর সিংয়ের দুটো ঠোক্কর, দুটো চারটে কদরের চটি পড়েনি। কোনো বেয়াড়া গাড়ি যদি বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করে তবে শেষ দাওয়াই তার ঘোমটা খুলে কানের কাছে বলা, ওক অমর সিংকে খবর দেওয়া হয়েছে। আর দেখতে হবে না। সেলফ-স্টার্টার না, হ্যাণ্ডিল না, হঠাৎ গাড়ি পাঁই পাঁই করে ছুটতে থাকে। ড্রাইভার কোনো গতিকে যদি পিছন দিকে ঝুলে পড়তে পারে তবেই রক্ষা।
কিন্তু হামেশাই দেখবেন লাইনের সবচেয়ে লজঝড় গাড়ি চালাচ্ছে অমর সিং। একটা মজা দেখবেন? বলে তিনি অমর সিংকে ডেকে বললেন, সর্দারজী, আমি একখানা নয়া গাড়ি কিনেছি। সিধা আমেরিকা থেকে আসছে। তুমি চালাবে? তখা এখন যা পাচ্ছ তাই পাবে।
অফিসারের নজরে পড়াতে সর্দারজী লে হাসিমুখে এসে সালাম করে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কথা শুনে মুখ গম্ভীর হল। পাগড়ির স্যাজটা দুহাতে নিয়ে সর্দারজী ভাঁজ করেন আর ভাজ খোলেন— নজরও ঐদিকে ফেরানন। তারপর বললেন, হুজুরের গাড়ি চালানো বড়ী ইজ্জকী বাৎ কিন্তু আমার পুরোনো চুক্তির মিয়াদ এখনো ফুরোয়নি।
অফিসার বললেন, তাই নাকি? বড় আফসোসের কথা। তা সে চুক্তি শেষ হলে আমায় খবর দিয়ে। আচ্ছা তুমি এখন যাও, আমি ক্ষুদে আগাকে (অর্থাৎ আমাকে) পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, দেখলেন তোত? নতুন গাড়ি সে চালাতে চায় না। চুক্তি-ফুক্তি সব বাজে কথা। আমার ড্রাইভারের দরকার শুনলে এ লাইনের কোন্ মোটরের গোঁসাই চুক্তির ফপরদালালি করতে পারে বলুন তো! তা নয়। অমর সিং নূতন গাড়ি চালিয়ে সুখ পায় না। পদে পদে যদি টায়ার না ফাটল, এঞ্জিন না বিগড়ল, ছাতখানা উড়ে না গেল, তবে সে মোটর চালিয়ে কি কেরামতি? সে গাড়ি তো বোরকা-পরা মেয়েই চালাতে পারে।