সাধারণ লোকের বিবেকবুদ্ধি এসব দেশে এরকম কথাই কয়। তবু আফগানিস্থান স্বাধীন সভ্য দেশ; আর পাঁচটা দেশ যখন খুনখারাবির প্রতি এত বেমালুম উদাসীন নয় তখন তাদেরও তো কিছু একটা করবার আছে এই ভেবে দুচারটে পুলিশ দু-একদিন অকুস্থলে ঘোরাঘুরি করে যায়। যদি দেখে আপনার আত্মীয়স্বজন কা তব কান্তা দর্শনে বুদ হয়ে আছেন অথবা শোনে যে খুনী কিম্বা তার সুচতুর আত্মীয়স্বজন আপনার আত্মীয়স্বজনকে চাকচিক্যময় বিশেষ বিরল ধাতুদ্বারা নাক কান চোখ মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, আপনারা জীবনের এই তিনদিনের মুসাফিরীতে কে দু ঘন্টা আগে গেল, কে দু ঘণ্টা পরে গেল, কে বিছানায় আল্লা রসুলের নাম শুনে শুনে গেল, কে রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে খাবি খেয়ে খেয়ে পাড়ি দিল এসব তাবৎ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, তবে বিবেচনা করুন, মহাশয়, পুলিশ কেন মিছে আপনাদের তথা খুনী এবং তস্য আত্মীয়স্বজনদের মামেলায় আরো ঝামেলা বাড়িয়ে সবাইকে খামকা, বেফায়দা তত্ব করবে? নির্বিকল্প বৈরাগ্য তো আর আপনাদের একচেটিয়া কারবার নয়, পুলিশও এই সার্বজনীন সার্বভৌমিক দর্শনে অংশীদার। তবে হাঁ, আলবৎ, এই নশ্বর সংসারে মাঝে মাঝে রুটি-গোস্তেরও প্রয়োজন হয়, সরকার যা দেন তাতে সব সময় কুলিয়ে ওঠে না, খুনীর আত্মীয়স্বজনকে যখন মেহেরবান খুদাতালা ধনদৌলত দিয়েছেন তখন–? তখন আফগান পুলিশকে আর দোষ দিয়ে কি হবে?
কিন্তু একটা বিষয়ে আফগান সরকার সচেতন— রাহাজানির যেন বাড়াবাড়ি না হয়। বুখারা সমরকন্দ শিরাজ তেহরানে যদি খবর রটে যায় যে, আফগানিস্থানের রাজবর্ত্ম অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল তাহলে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে ও আফগান সরকারের শুল্ক-হংস স্বর্ণডিম্ব প্রসব করা বন্ধ করে দেবে।
ডানদিকে ড্রাইভার শিখ সর্দারজী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। কাঁচাপাকা দীর্ঘ দাড়ি ও পরে জানতে পারলুম রাতকানা। বাঁ দিকে আফগান সরকারের এক কর্মচারী। পেশাওয়ার গিয়েছিলেন কাবুল বেতারকেন্দ্রের মালসরঞ্জাম ছাড়িয়ে আনবার জন্য। সব ভাষাই জানেন অথচ বলতে গেলে এক ফারসী ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই জানেন না। অর্থাৎ আপনি যদি তাঁর ইংরিজী না বোঝেন তবে তিনি ভাবখানা করেন যেন আপনিই যথেষ্ট ইংরিজী জানেন না, তখন তিনি ফরাসীর যে ছয়টি শব্দ জানেন সেগুলো ছাড়েন। তখনো যদি আপনি তার বক্তব্য না বোঝেন তবে তিনি উর্দু ঝাড়েন। শেষটায় এমন ভাব দেখান যে অশিক্ষিত বর্বরদের সঙ্গে কথা বলবার ঝকমারি আর তিনি কত পোহাবেন? অথচ পরে দেখলুম ভদ্রলোক অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, বিপন্নের সহায়। তারো পরে বুঝতে পারলুম ভাষা বাবতে ভদ্রলোকের এ দুর্বলতা কেন যখন শুনতে পেলুম যে তিনি অনেক ভাষায় পাণ্ডিত্যের দাবি করে বেতারে চাকরী পেয়েছেন। আমার সঙ্গে দুদিন একাসনে কাটাবেন–আমি যদি কাবুলে গিয়ে রটাই যে, তিনি গণ্ডুষজলের সফরী তাহলে বিপদআপদের সম্ভাবনা। কিন্তু তার এ ভয় সম্পূর্ণ অমূলক ছিল— তার অজানতে বড়কর্তাদের সবাই জানতেন, ভাষার খাতে তার জ্ঞানের জমা কতটুকু। তবু যে তিনি চাকরীতে বহাল ছিলেন তার সরল কারণ, অন্য সবাই ভাষা জানতেন তার চেয়েও কম। এ তত্ত্বটি কিন্তু তিনি নিজে বুঝতে পারেননি। সরল প্রকৃতির লোক, নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে এতই ব্যস্ত যে পরের অজ্ঞতা তাঁর চোখে পড়ত না। গুণীরা বলেন, চোখের সামনে ধরা আপন বন্ধমুষ্টি দূরের হিমালয়কে ঢেকে ফেলে।
বাসের পেটে একপাল কাবুলী ব্যবসায়ী। পেশাওয়ার থেকে সিগারেট, গ্রামোফান, রেকর্ড, পেলেট-বাসন, ঝাড়-লণ্ঠন, ফুটবল, বিজলি-বাতির সাজসরঞ্জাম, কেতাব-পুথি, এক কথায় দুনিয়ার সব জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আফগান শিল্প প্রস্তুত করে মাত্র তিন বস্তু বন্দুক, গোলাগুলী আর শীতের কাপড়। বাদবাকি প্রায় সব কিছুই আমদানি করতে হয় হিন্দুস্থান থেকে, কিছুটা রুশ থেকে। এসব তথ্য জানবার জন্য আফগান সরকারের বাণিজ্য-প্রতিবেদন পড়তে হয় না, কাবুল শহরে একটা চক্কর মারলেই হয়।
সে সব পরের কথা।
আগের দিন পেশাওয়ারে ১১৪ ডিগ্রী গরম পড়েছিল— ছায়াতে। এখন বাস যাচ্ছে যেখান দিয়ে সেখান থেকে দূরবীন দিয়ে তাকালেও একটি পাতা পর্যন্ত চোখে পড়ে না। থাকার মধ্যে আছে এখানে ওখানে পাথরের গায়ে হলদে ঘাসের পোঁচ।
হস্টেলে স্টোভ ধরাতে গিয়ে এক আনাড়ী ছোকরা একবার জ্বলন্ত স্পিরিটে আরো স্পিরিট ঢালতে গিয়েছিল। ধপ করে বোতলে স্টোভে সর্বত্র আগুন লেগে ছোরার ভুরু, চোখের লোম, মোলায়েম গোপ পুড়ে গিয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে এক অপরূপ রূপ ধারণ করেছিল। এখানে যেন ঠিক তাই। মা ধরণী কখন যেন হঠাৎ তার মুখোনা সূর্যদেবের অত্যন্ত কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে আগুনের এক থাবড়ায় তার চুল ভুরু সব পুড়ে গিয়ে মাটির চামড়া আর ঘাসের চুলের সেই অবস্থা হয়েছে।
এরকম ঝলসে-যাওয়া দেশ আর কখনো দেখিনি। মরুভূমির কথা আলাদা। সেখানে যা কিছু পোড়বার মত সে সব আমাদের জন্মের বহুপূর্বে পুড়ে গিয়ে ছাই হয়ে উড়ে চলে গিয়েছে মরুভূমি ছেড়ে সার হয়ে নূতন ঘাসপাতা জন্মাবার চেষ্টা আর করেনি। সূর্যদেব সেখানে একচ্ছত্রাধিপতি। এখানে নগ্ন বীভৎস দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব বলা ভুল–এখানে নির্মম কঠোর অত্যাচার। ধরণী এদেশকে শস্যশ্যামল করার চেষ্টা এখনো সম্পূর্ণ ছাড়তে পারেননি প্রতি ক্ষীণ চেষ্টা বারে বারে নির্দয় প্রহারে ব্যর্থ হচ্ছে। পূর্ববঙ্গের বিদ্রোহী প্রজার কথা মনে পড়ল। বার বার তারা চরের উপর খড়ের ঘর বাঁধে, বার বার জমিদারের লেঠেল সব কিছু পুড়িয়ে দিয়ে ছারখার করে চলে যায়।