রমজান খান বললেন, বুঝতেই পারছেন, পরোপকার করতে গিয়ে বেনের পোর অবস্থা। ভাগ্যিস সিন্ধু সেখানে চওড়া এবং বেনেরা আর কিছু পারুক না-পারুক ছুটতে পারে আরবী ঘোড়ার চেয়েও তেজে। সে-যাত্রা বেনে বেঁচে গেল।
আমি বললুম, গল্পটি উপাদেয়, কিন্তু বাঙালীর সঙ্গে মিলগরমিলের এতে আছে কোন্ চীজ?
রমজান খান বললেন, বাঙালী আপন দেশে বসে, এভারেস্টের গায়ে ফিতে না লাগিয়ে, চুড়োয় চড়তে গিয়ে খামখা জান না দিয়ে ইংরেজকে বাৎলে দেয়নি, ঐ দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়?
আমি বললুম, হাঁ, কিন্তু নাম হয়েছে ইংরেজের।
আহমদ আলী শুধালেন, তাই বুঝি বাঙালী চটে গিয়ে ইংরেজকে বোমা মারে?
আমি অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় চুলকে বললুম, সেও একটা অতি সূক্ষ্ম কারণ বটে, তবে কিনা শিকদার এভারেস্ট সায়েবকে বোমা মারেননি।
রমজান খান উম্মা দেখিয়ে বললেন, কিন্তু মারা উচিত ছিল।
আমি বললুম, হুঁ, কিন্তু একটু সামান্য টেকনিকল মুশকিল ছিল। নামকরণ যখন হয় শিকদার তখন কলকাতায় আর মহামান্য স্যার জর্জ লণ্ডনে পেনসন টানছেন। পাল্লাটা
পুরো পাঠান এবং নিমপাঠান এক সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। শুধালেন, তার মানে? তবে কি ও লোকটার তদারকিতেও এভারেস্ট মাপা হয়নি?
আমি বললুম, না। কিন্তু আপনারা এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? এই আপনাদের ভাইবেরাদরই কতবার কাবুল দখল করেছেন আমার ঠিক স্মরণ নেই, কিন্তু এই কথাটা মনে গাঁথা আছে যে, নাম হয়েছে প্রতিবারেই ইংরেজের। আর আপনারা যখনই হাত গুটিয়ে বসেছিলেন তখনই হয় ইংরেজ কচুকাটা হয়ে মরেছে, নয় আপনাদের বদনাম দিয়ে নিজের অপমান জালার মত মোটা মোটা মেডেল পরে ঢেকেছে। এই গেলবারে যখন দুখানা আকবরশাহী কামান আর তিনখানা জাহাঙ্গিরী বন্দুক দিয়ে আমান উল্লা ইংরেজকে তুলোধোনা করে ছাড়লেন, তখন ইংরেজ তামাম দুনিয়াকে ঢাক পিটিয়ে শোনায়নি যে, পাঠানের ফেরেজিতেই তারা লড়াই হারল?
রমজান খান বললেন, বাঙালী এত খবর রাখে কেন?
আমি বললুম, কিছু যদি মনে করেন, আর গোস্তাকি বেয়াদবি মাফ করেন, তবে সবিনয় নিবেদন, আপনারা যদি একটু বেশী খবর রাখেন তা হলে আমরা নিষ্কৃতি পাই।
দুজনেই চুপ করে শুনলেন। তারপর আহমদ আলী বললেন, সৈয়দ সাহেব, কিছু মনে করবেন না। আপনারা বোমা মারেন, রাজনৈতিক আন্দোলন চালান, ইংরেজ আপনাদের ভয়ও করে। এসব তো আরম্ভ হয়েছে মাত্র সেদিন। কিন্তু বলুন তো, যেদিন দুনিয়ার কেউ জানত না ফ্রন্টিয়ার বলে এক ফালি পাথরভর্তি শুকনো জমিতে একদল পাহাড়ী থাকে সেদিন ইংরেজ তাদের মেরে শেষ করে দিত না, যদি পারত? ফসল ফলে না, মাটি খুঁড়লে সোনা চাঁদি কয়লা তেল কিছুই বেরোয় না, এক ফোঁটা জলের জন্য ভোর হবার তিন ঘণ্টা আগে মেয়েরা দল বেঁধে বাড়ি থেকে বেরোয়, এই দেশ কামড়ে ধরে পড়ে আছে মূর্খ পাঠান, কত যুগ ধরে, কত শতাব্দী ধরে কে জানে? সিন্ধুর ওপারে যখন বর্ষায় বাতাস পর্যন্ত সবুজ হয়ে যায় তখন তার হাতছানি পাঠান দেখেনি? পূরবৈয়া ভেজা ভেজা হাওয়া অদ্ভুত মিঠে মিঠে গন্ধ নিয়ে আসে, আজ পর্যন্ত কত জাত তার নেশায় পাগল হয়ে পুব দেশে চলে গিয়েছে— যায়নি শুধু মূর্খ আফ্রিদী মোমন।
লড়াই করে যখন ইংরেজ এদেশকে উচ্ছন্ন করতে পারল না তখন সে প্রলোভন দেখায়নি। লাখ লাখ লোক পল্টনে ঢুকল। ইংরেজের ঝাণ্ডা এদেশে উড়ল বটে, কিন্তু তার রাজত্ব ঐ ঝাণ্ডা যতদূর থেকে দেখা যায় তার চেয়েও কম। আর পল্টনে না ঢুকে পাঠান করতই বা কি? পাঠানমোগল আমলে তাদের ভাবনা ছিল না। পল্টনের দরওয়াজা খোলা, অথচ মোগলপাঠান এই গরীব দেশের গাঁয়ে গাঁয়ে ঢুকে বুড়ার রুটি কাড়তে চায়নি, বউঝিকে বিদেশী হারাম কাপড় পরাতে চায়নি। শাহানশাহ বাদশাহ দীনদুনিয়ার মালিক দিল্লীর তখত্নশীন সরকার-ই-আলা যখন হিন্দুস্থানের গরম বরদাস্ত না করতে পেরে এদেশ হয়ে ঠাণ্ডা সবুজ মোলায়েম কাবুল শহর যেতেন পাঠান তখন তাকে একবার তসলীম দিতে আসত। শাহানশাহ খুশ, পাঠান তরূ। বাদশাহের মীর-বখশী পিছনের তাঞ্জাম থেকে মুঠা মুঠা আশরফী রাস্তার দুদিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেন। জিন্দাবাদ শাহানশাহ জহানপনা চিৎকার খাইবারের দুদিকের পাহাড়ে টক্কর খেয়ে খেয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে খুদাতালার পা-দানে গিয়ে যখন পৌঁছত তখন সে প্রশংসাধ্বনি লক্ষ কণ্ঠের নয়, কোটি কোটি কণ্ঠের। সে আশরফী আজ নেই, পর্বতগাত্রে প্রশংসার প্রতিধ্বনিত হয় না, কিন্তু ঐ পাথরের টুকরোগুলো পাষাণ পাঠান আপন ছাতির খুন দিয়ে এখনো স্বাধীন রেখেছে। তাই তার নাম এখনো নো ম্যান্স ল্যাণ্ড। পাঠান আর কি করতে পারত, বলুন।
আমি অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে বারবার আপত্তি জানিয়ে বললুম, আমি সে অর্থে কথাটা বলিনি। আমি ভদ্রসন্তানদের কথা ভাবছিলুম এবং তাঁরাও কিছু কম করেননি। তাঁরা অসন্তোষ প্রকাশ না করলে পাঠান সেপাই হয়তো আমান উল্লার বিরুদ্ধে লড়ত।
আহমদ আলী বললেন, ভদ্রসন্তানদের কথা বাদ দিন। এই অপদার্থ শ্রেণী যত শীঘ্র মরে ভূত হয়ে অজরঈলের দফতরে গিয়ে হাজিরা দেয় ততই মঙ্গল।
রমজান খান আপত্তি জানিয়ে বললেন, ভদ্রসন্তানদের পড়ার কায়দা আর পাঠান সিপাহির লড়ার কায়দা তো আর এক ধরনের হয় না। সময় যেদিন আসবে তখন দেখতে পাবেন আমাদের অপদার্থ আহমদ আলী কোন্ দলে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আমি আহমদ আলীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালুম। আহমদ আলী বললেন, আমি সব কথা ভালো করে শুনতে পাইনে। একটু কালা-খুদাতালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
০৭. আরবী ভাষার প্রবাদ
আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে–ইয়োম্ উস্ সফ্র্, নিস্ফ্ উস্ সফ্র্–অর্থাৎ কিনা যাত্রার দিনই অর্ধেক ভ্রমণ। পূর্ব বাঙলায়ও একই প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেখানে বলা হয়, উঠোন সমুদ্র পেরলেই আধেক মুশকিল আসান। আহমদ আলীর উঠোন পেরতে গিয়ে আমার পাক্কা সাতদিন কেটে গেল। আটদিনের দিন সকালবেলা আহমদ আলী স্বয়ং আমাকে একখানা বাদে ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে তাকে আমার জান-মাল বাঁচাবার জন্য বিস্তর দিব্যদিলাশা দিয়ে বিদায় নিলেন। হাওড়া স্টেশনে মনে হয়েছিল আমি একা, এখন মনে হল আমি ভয়ঙ্কর একা। ভয়ঙ্কর একা এই অর্থে যে নো ম্যানস ল্যাণ্ডই বলুন আর খাস আফগানিস্থানই বলুন এসব জায়গায় মানুষ আপন আপন প্রাণ নিয়েই ব্যস্ত। শুনেছি, কাবুলের বাইরেও নাকি পুলিশ আছে, কিন্তু আফগান আইনে খুন পর্যন্ত এখনো ঠিক কগনিজেবল অফেন্স্ নয়। রাহাজানির সময় যদি আপনি পাঠানী কায়দায় চটপট উবুড় হয়ে শুয়ে না পড়েন তাহলে সে ভুল অথবা গোঁয়ার্তুমির খেসারতি দেবেন আপনি। রাস্তাঘাটে কি করে চলতে হয় তার তালিম দেওয়া তো আর আফগান সরকারের জিম্মায় নয়। কীপ টু দি লেফ্ট তো আর ইংরেজ সরকার আপনাকে ইস্কুলে নিয়ে গিয়ে শেখায় না। এবং সর্বশেষ বক্তব্য, আপনি যদি প্রাণটা নিতান্তই দিয়ে দেন তবে আপনার আত্মীয়স্বজন তো রয়েছেন–তারা খুনের বদলা নিলেই তো পারেন। একটা বুলেটের জন্য তো আর তালুকমুলুক বেচতে হয় না, পারমিটও লাগে না।