টাঙ্গায় উঠেই আনোয়ারীবাঈ অস্বস্তি বোধ করলেন। বুকের বাঁ দিকে তীব্র ব্যথা! টনটন করে উঠল চোখের দুটো পাতা।
কি হল, কষ্ট হচ্ছে?মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
না, ঘাড় নাড়লেন আনোয়ারীবাঈ, কোন কষ্ট হচ্ছে না। কেবল বুকের ভিতর অসহ্য দাপাদাপি। এত বছর পরে মেয়েকে দেখতে পাবেন, যে মেয়েকে দু হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন পঙ্কিল পরিবেশ থেকে, বাঈজীর ঘৃণ্য জীবন থেকে উন্নীত করেছেন গৃহবধূর পর্যায়ে। তাই বুঝি হৃদয় অধৈর্য হয়ে পড়েছে, অপেক্ষা করতে মন সরছে না।
টাঙ্গা যখন গিয়ে পৌঁছল তখন অতিথি-অভ্যাগতেরা সবাই এসে গিয়েছেন। জোর বাতির নিচে ঝলমলে রঙিন পোশাকের সার। এতদূর থেকেও প্রসাধনের উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল, মদির সুবাসা কিছু কিছু লোককে মনোহরপ্রসাদ চিনতে পারল, শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবার। আমিনাবাদের রিটায়ার্ড জজ কেশরী সুকুল থেকে শুরু করে নবাবের বংশধর আমিনউদ্দিন। সেরা ব্যবসায়ী মিস্টার মোদির পাশাপাশি ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হেনরী উড। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন আত্মীয়া আর বান্ধবীর দলা কলরবে জায়গাটা সরগরমা মাঝখানে মেজর বর্মাকে দেখা গেল। ঘুরে ঘুরে তদারক করছেন, মাঝে মাঝে চোখ ফেরাচ্ছেন বাড়ির দিকে স্ত্রীর আসার প্রত্যাশায়।
দরোয়ানই বলল, মেমসায়েব এখনও নামেন নি, বোধ হয় সাজছেন।
আনোয়ারীবাঈ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন গাড়ি-বারান্দার দিকে। ঐখান দিয়েই তো মোতি আসবে। আনোয়ারীবাঈয়ের আত্মজা, তাঁরই রক্ত-মাংসে গড়ে তোলা স্বতন্ত্র সত্তা।
হঠাৎ আলোড়ন উঠল অতিথিদের মধ্যে সবাই দাঁড়িয়ে উঠলেন। মেজর বর্মা এগিয়ে এলেন দু-এক পা।
পাতলা ফিনফিনে ব্লাউজ কটি উদঘাটিনী, হালকা সবুজ রংয়ের আরো পাতলা শাড়ি। অন্তর্বাস দিনের আলোর মতন স্পষ্ট। আঁকা, ঠোঁটে কৃত্রিম লালিমা, দু-গালে রুজের রক্তিম আমেজ, সুর্মাটানা দুটি চোখকে আয়ত করার দুর্লভ প্রচেষ্টা, চুড়ো-বাঁধা কটা চুলের রাশা
চেয়ে চেয়ে দেখলেন আনোয়ারীবাঈ। সেদিনের সে মেয়েটির সামান্যতম পরিচয়ও নেই মিসেস বর্মার মধ্যে শান্ত সুন্দর মেয়েটা কি মন্ত্রে রূপান্তরিত হল আজকের এই উৎকট বিলাসিনীতে! যে পোশাক পরে আনোয়ারীবাঈ নিভৃতে বিশেষ কোন অতিথির সামনে আসতেও লজ্জা পেতেন, কি করে মোতি হাজার অতিথির মাঝখানে এসে দাঁড়াল সেই পোশাকে!
মিসেস বর্মাকে নিয়ে যেন লোফালুফি শুরু হল। অপূর্ব ভঙ্গীতে মোতি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে সরে সরে যেতে লাগল। কোথাও কোন পুরুষের চটুল উক্তিতে নিচু হয়ে তার গালে আলতো করাঘাত করে বলল, Naughty boy, আবার কোথাও কোন পুরুষের বাটনহোল থেকে গোলাপ তুলে নিয়ে নিজের কবরীতে গাঁথলা কারো টেবিলে বসে হেসে গড়িয়ে পড়ল অতিথির গায়ের ওপর, লিপস্টিক-রক্তিম ঠোঁট দুটো ফাঁক করে মোহিনী হাসি উপহার দিয়ে আবার সরে গেল অন্য টেবিলে।
মনোহরপ্রসাদের টনক নড়ল আচমকা মণিবন্ধে টান পড়তে হাত দিয়ে মুখ ডেকে আনোয়ারীবাঈ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। থর থর করে কাঁপছে গোটা শরীর।
টাঙ্গা অপেক্ষা করছিল, আর দেরি করল না মনোহরপ্রসাদ। সাবধানে আনোয়ারীবাঈকে ধরে গাড়িতে নিয়ে এল। কি ভাগ্যিস, জোর ব্যান্ড শুরু হয়েছে লনে, আনোয়ারীবাঈয়ের উচ্ছ্বসিত কান্নার আওয়াজ কারো কানে যায়নি।
কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? মনোহরপ্রসাদ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল।
এতদিন পরে নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখলে কষ্ট হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। এইজন্যই আনতে চায় নি আনোয়ারীবাঈকে।
না, না, শরীর আমার খুব ভাল আছে। কিন্তু কি হল ভাইসায়েব! বাঈজীর মেয়ে বাঈজীই হয়ে রইল! ছেলেবেলা থেকে কাছছাড়া করেও রক্তের দোষ ছাড়াতে পারলাম না! পোশাক-আশাক, রং-ঢং, চালচলন—এ সবে চকের রাস্তায় দাঁড়ানো বাঈজীদেরও যে হার মানাল! এ কি হল ভাইসাব, এ আমার কি হল!
দু-হাতে মুখ ঢেকে আনোয়ারীবাঈ আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।