তারপর বছর কয়েক কোন খবর নেই। পুরনো ঠিকানায় চিঠি দিয়েও মনোহরপ্রসাদ কোন উত্তর পায়নি। হঠাৎ চিঠি এল মজঃফরপুর থেকে লিখেছেন মায়াবতী শকসেনা, ব্রজবিলাসের বিধবা স্ত্রী সামনের মাসে মোতির বিয়ে, আর্মি অফিসর মোহনচাঁদ বর্মার সঙ্গে তাঁর স্বামী হঠাৎই মারা গেছেন। অফিসের টেবিলে হার্টফেল করে। এই বিয়েতে মনোহরপ্রসাদ অনুগ্রহ করে যদি পায়ের ধুলো দেন তো সবাই কৃতাৰ্থ বোধ করবে।
মনোহরপ্রসাদ যেতে পারেনি, কিন্তু আনোয়ারীবাঈকে পড়িয়ে শুনিয়েছিল সে চিঠিা তখন আনোয়ারীবাঈয়ের অবস্থা পড়তির মুখো রোগে ধরেছে। লোকের আসা-যাওয়া অনেক কম। প্রায় খালিই পড়ে থাকে জলসাঘর। বাড়িভাড়াও কিছু কিছু বাকি পড়েছে। ভাবছেন সরে গিয়ে কোথাও আরো ছোট বাড়ি ভাড়া করবেন। চকের আরো ভিতরের দিকে।
সেদিন বাক্স হাতড়ে একটা মুক্তার মালা বের করেছিলেন আনোয়ারীবাঈ। ঝুটো নয়, খাঁটি মুক্তা। বোম্বাইয়ের আমীর মকবুল আলির উপহার। খুব বড়ো বড়ো জায়গায় যেতে আসতে আনোয়ারীবাঈ গলায় দিতেন মোতির বিয়েতে সেটাই পাঠিয়ে দিলেন।
বিয়েতে মনোহরপ্রসাদ যায় নি, কিন্তু দিন পাঁচেক পরে বিয়ের বিস্তারিত বিবরণ পড়েছিল খবরের কাগজের পাতায়। খুব ধুমধাম। দু হাজারের ওপর মাননীয় অতিথি জাঁদরেল সব অভ্যাগতের লিস্টা সে খবরও মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈকে শুনিয়েছিলা। আজকাল কি যে হয়েছে আনোয়ারীবাঈয়ের! বোধহয় বয়স হয়েছে বলেই, একটুতেই জল জমা হয় চোখের কোণে, দুটো ঠোঁট থরথরিয়ে কাঁপে, আর ঠিক বুকের বাঁ পাশে অসহ্য যন্ত্রণা। নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়।
আনোয়ারীবাঈ বিড় বিড় করে বললেন একবার মোতিকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে। দূর থেকে একটু দেখে আসা।
মনোহরপ্রসাদ এ কথার কোন উত্তর দেয়নি। অবশ্য মায়াবতী শকসেনাকে চিঠিপত্র লিখে মোতির সঙ্গে যোগাযোগ হয়তো করা যায়, কিন্তু মেয়ে সুখী হয়েছে, ভালো ঘরে, ভালো বরে পড়েছে, এই তো যথেষ্টা চোখে দেখতে যাওয়া মানেই তো মায়া বাড়ানো। আরো কষ্ট পাওয়া।
মনোহরপ্রসাদ লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে গিয়েছিল।
তারপর কয়েক বছর আর কোন খোঁজখবর নেই। কোন চিঠিপত্রও দেননি মায়াবতী শকসেনা।
মাঝে মাঝে দেখা হলেই আনোয়ারীবাঈ বলেছেন, আর কটা দিনই বা বাঁচব, যাবার আগে বড় দেখতে ইচ্ছা করছে মোতিকে
মনোহরপ্রসাদ আমল দেয়নি। বলা যায় না মেয়েমানুষের মন। এমনিতে আনোয়ারীবাঈ খুব শক্ত, বাইরে কাঠিন্যের দুর্ভেদ্য আবরণ, কিন্তু চোখের সামনে নিজের মেয়েকে দেখতে পেলে, সে নির্মোক হয়তো খসে পড়বো কেঁদে ফেলবেন আনোয়ারীবাঈ। অযথা একটা গোলমালের সৃষ্টি। আর্মি অফিসার মোহনচাঁদ বিরক্ত হবেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়াও বিচিত্র নয়া।
হঠাৎ সকালে খবরের কাগজটা ওলটাতে ওলটাতে মনোহরপ্রসাদের চোখে পড়ে গেল। বার বার পড়ল খবরটা, কাগজটা চোখের কাছ বরাবর নিয়ে, তারপরই খবরটা নিয়ে গেল আনোয়ারীবাঈয়ের কাছে।
মেজর মোহনচাঁদ বর্মা জলন্ধর থেকে বদলী হয়েছেন লক্ষৌ সামনের সোমবার থেকে নতুন জায়গার কার্যভার গ্রহণ করবেন
আনোয়ারীবাঈ এগিয়ে এসে একেবারে মনোহরপ্রসাদের দুটো হাত জড়িয়ে ধরলেন।
আমি মোতিকে দেখব। চুপচাপ দেখে চলে আসব। ওর বাড়ির রাস্তায় বসে থাকব, ও বাইরে বেরোবার সময়ে একবার শুধু চোখের দেখা দেখবা ভাইসায়েব, এইটুকু উপকার করতেই হবে। আমি বুঝতে পারছি, আর আমি বেশিদিন নেই।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারীবাঈ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
আচ্ছা দেখি মনোহরপ্রসাদ হাত ছাড়িয়ে বাইরে চলে এল।
বাইরে চলে এল বটে, কিন্তু কথাটা ভুলল না। বিকেলের দিকে টাঙ্গায় চড়ে হাজির হল। বাদশাবাগো বেশি ঘুরতে হল না। রাস্তার ওপরেই খাসা ঝকঝকে দুতলা। বোগেনভিলার গেট, নিচু পাঁচিল আইভি-জড়ানো রাস্তা থেকেই পুরো লন নজরে আসে। বাহারে গাছের ছিটে দেওয়া মখমল-নরম লন।
এগিয়ে গিয়ে তকমা-আঁটা দরোয়ানের সঙ্গেও মনোহরপ্রসাদ আলাপ জমিয়ে ফেলল। মেহমান আদমি, ঘুরে ঘুরে দেখছে সারা শহর। চমৎকার বাড়ি যেমন বাড়ি তেমনি বাগান ভাগ্যবান মালিকটি কে?
মালিক আডভানি সায়েব, দরোয়ানের ভাগ্যে এমন শ্রোতা সচরাচর জোটে না, টুলে বসে আয়েস করে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, উপস্থিত ভাড়া নিয়েছেন মেজর বর্মা। নতুন এসেছেন এখানে সামনের রবিবার খানাপিনা আছে। শহরের জাঁদরেল লোকদের আমন্ত্রণ। এখানকার সমাজে পরিচিত হতে চান মেজর সায়েবা
বটে, মনোহরপ্রসাদ কল্পিত বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল, খানাপিনা হবে কোথায়? কার্লটন হোটেলে?
উঁহু, হোটেলে কেন, সায়েব এই লনে বন্দোবস্ত করতে বলেছেন। বাইরের লনই তো ভালা দরোয়ান বিজ্ঞের মতন ঘাড় নাড়ল।
তা তো নিশ্চয়! সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল মনোহরপ্রসাদ, তারপর একটু থেমে বলল, বিবিজী নেই বাড়িতে, না সায়েব একা?
হ্যাঁ। বিবিজী আছেন বই কি জিনিস কিনতে হজরতগঞ্জ গেছেন। বিবিজীই তো সব। তিনি ঘোরান, সায়েব ঘোরেন।
দরোয়ানের গলা পরিহাস-তরল। মনোহরপ্রসাদ আর কথা বাড়াল না। ধন্যবাদ জানিয়ে টাঙ্গায় এসে উঠল।
ওই কথাই ঠিক হল। সন্ধ্যার ঝোঁকে মনোেহরপ্রসাদ টাঙ্গা নিয়ে আসবে। আনোয়ারীবাঈ সঙ্গে যাবেন নিচু পাঁচিল, রাস্তা থেকে দেখার কোন অসুবিধা নেই। আর তেমন হলে বেড়ার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেই চলবে। দরোয়ানের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ভিতরে না ঢুকতে দিতে পারে, বেড়ার বাইরে দাঁড়ালে আপত্তি করবে না। খানাপিনার ব্যাপার যখন, লনে আলোর বন্দোবস্ত নিশ্চয় থাকবে। আনোয়ারীবাঈয়ের দেখতে কোন অসুবিধা হবে না। ঠিক চিনতে পারবেন আত্মজাকে। চোখ ভরেই শুধু নয়, মন ভরেও দেখতে পাবেন।