মনোহরপ্রসাদ আসমানের চাঁদ পেল হাতের মুঠোয়। তকলিফ করে আসমানে চড়তে হল না, চাঁদ নিজেই যেন নেমে এসে ধরা দিল।
দোস্তের মারফত আলাপ হল। প্রথম প্রথম দু-একটা সান্ত্বনার মোলায়েম কথা, মিঠে মিঠে উপদেশ, দুনিয়ার কিছুই স্থায়ী নয় সে সম্বন্ধে দার্শনিক আলোচনা। তারপর আসতে আসতে কথাটা পাড়ল। খুব সাবধানে
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মনোহরপ্রসাদের দিকে, তারপর ধীর গলায় বললেন, কিন্তু যাদের মেয়ে তারা ছাড়বে কেন?
ছাড়বে কেন! মনোহরপ্রসাদ কপালে হাত চাপড়ালেন, বাপ গেছে অনেকদিন, মা যে অবস্থায় আছে, দুবেলা দুখানা রুটিও দিতে পাচ্ছে না মেয়েকে কোনদিন দেখব মা আর মেয়ে দুজনেই খতম হয়ে গেছে। নয়তো মা কি আর অত সহজে ছাড়তে চায় মেয়েকে!
ভদ্রলোক উঠে ভিতরে গেলেন, বোধহয় পরামর্শ করলেন স্ত্রীর সঙ্গে, তারপর বাইরে এসে বললেন, একবার দেখাতে পারেন মেয়েটাকে?
বহুৎ খুব, বলেন তো কালই নিয়ে আসতে পারি।
বেশ তাই নিয়ে আসবেন।
সোজা মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈয়ের সঙ্গে দেখা করলা সব ঘটনা জানালা পরের দিন সকালে মোতিকে নিয়ে যাবে তাও বলল।
মনোহরপ্রসাদ ভেবেছিল, সব ঠিকঠাক হলে আনোয়ারীবাঈ বোধহয় রাজী হবেন না। প্রাণ ধরে ছাড়তে পারবেন না মেয়েকে। কিন্তু আনোয়ারীবাঈ একটুও আপত্তি করলেন না। সামান্য বাধাও নয়। কেবল বললেন, তোক বেশ ভাল তো ভাইসায়েব? মোতির কোন কষ্ট হবে না?
নিজের পেটের মেয়ে হারিয়েছে, এখন যাকে নেবে, তাকে নিজের মেয়ের মতনই মানুষ করবে। আর তাছাড়া তোক খুব ভদ্র। খানদানী ঘরের ছেলে, শুনলাম লেখাপড়াও খুব জানো।
আনোয়ারীবাঈ আর কিছু বললেন না, কিন্তু পরের দিন মনোহরপ্রসাদ মোতিকে নিতে গিয়েই অবাক। দামী শালোয়ার, দোপাট্টা, পায়জামায় ঝলমল করছে মেয়ে। গলায় মুক্তার মালা, কানে। পান্নার দুল পায়ে ভেলভেটের নাগরা।
সর্বনাশ, এই বুঝি অভাব অনটনে দিন কাটানো মেয়ের পোশাকের বহর!
কথাটা মনোহরপ্রসাদ বলল আনোয়ারীবাঈকে।
এত সব দামী জামা গয়না পরিয়েছেন কেন? গরিবের মেয়ে, এই কথাই তো জানানো হয়েছে।
তবে? এই এতক্ষণ পরে একটু যেন ছলছলিয়ে এল আনোয়ারীবাঈয়ের চোখ ভিজে ভিজে গলা।
সব খুলে ফেলব?
মনোহরপ্রসাদ ভাবল দু-এক মিনিট, তারপর বলল, শালোয়ার পাজামা না হয় থাক, গয়নাগুলো খুলে নিতে হবে।
আনোয়ারীবাঈ এক এক করে সব খুলে নিলেন মেয়েকে সারারাত ধরে বুঝিয়েছেন। নতুন জায়গায় গিয়ে বেফাঁস কিছু না বলে ফেলে, কান্নাকাটি না করে বাইরে যাবেন আনোয়ারীবাঈ। তীর্থধর্ম করতো সেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের যেতে নেই। ফিরে এসে মোতিকে তিনি নিয়ে আসবেন।
কার কাছে যাব মা! মোতি অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করেছে।
তোমার কাকা-কাকীর কাছে। দেখবে কত যত্ন করবে, ভালবাসবে, জিনিস কিনে দেবে।
মোতি আর কথা বলে নি। এখানে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কমা মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈ শহরে যান মুজরো নিয়ে খুব দূরে কোথাও নয়, ধারে কাছেই। কানপুর, বেরিলি, ফয়জাবাদা সেই সময় মোতি থাকে বুড়ি ঝির কাছে। এখানে থাকলেও আনোয়ারীবাঈ ধারে কাছে ঘেঁষতে দেন না মেয়েকে। গান বাজনার আসরে এসে কাজ নেই। সারেঙ্গীর সুর আর তবলার বোলে শুধু সুর নয়, বিষও আছে। একবার নেশা ধরলে আর রক্ষা নেই।
মোতিকে নিয়ে যাবার সময় ধারে কাছে আনোয়ারীবাঈকে দেখা গেল না। এদিক-ওদিক চেয়েও মনোহরপ্রসাদ তাঁর খোঁজ পেলেন না।
ভদ্রলোকের নাম ব্রজবিলাস শকসেনা। আদি নিবাস মজঃফরপুরা বিলেতে ছিলেন বছর চারেক। স্ত্রী পর্দানসীন নন, কেবল আনকোরা শোক পেয়ে বাইরে বেরোনো বন্ধ করেছেন। মোতিকে দেখে ব্রজবিলাসবাবুর স্ত্রী পর্দা ঠেলে সদরে চলে এলেন। দু হাতে মোতিকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। ব্রজবিলাসবাবু কাঁদলেন না বটে, কিন্তু তাঁর মুখ চোখের ভাবে মনে হল, মেয়ের শোকটা আবার নতুন করে যেন দেখা দিল
মোতিকে তাঁরা ছাড়লেন না। কথা হল মনোহরপ্রসাদ বিকেলে এসে মোতিকে নিয়ে যাবে, আবার পরের দিন সকালে মোতির জামাকাপড় বিছানাপত্র যা আছে সবসুদ্ধ নিয়ে আসবে। সেই সঙ্গে মোতিকেও।
যাবার মুখে ব্রজবিলাসবাবু মনোহরপ্রসাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন।
একটা কথা ছিল।
বলুন।
কিছু টাকা ওর মাকে দিতে চাই। যদি আপনি নিয়ে যান সঙ্গে করে।
মনোহরপ্রসাদ দুহাত জোড় করলা বিনীত গলায় বলল, কসুর মাফ করবেন। টাকা নিতে ওর মা হয়তো রাজী হবেন না। তাহলে মেয়েকে বিক্রি করার সামিলই হবে মেয়েকে মানুষ করে তুলুন আপনারা, তাতেই উনি খুশি হবেন।
তারপর থেকে মেয়ের সঙ্গে আর আনোয়ারীবাঈয়ের দেখা হয়নি। দেখা হয়নি বটে, তবে খোঁজখবর পেয়েছেন মনোহরপ্রসাদের মারফত। বছর তিনেক পরেই ব্রজবিলাস বদলি হলেন মীরাট, সেখান থেকে দেরাদুন ছুঁয়ে গেলেন আগ্রা সব জায়গা থেকেই চিঠিপত্রে যোগাযোগ রেখেছিলেন মনোহরপ্রসাদের সঙ্গে চিঠিতে বেশির ভাগই মোতির কথা। মোতির মা যে বাঈজী ছিলেন, সেকথা মোতির কাছ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু তাঁদের কোন আক্ষেপ নেই। পিছন দিকে চাইতে আর তাঁরা রাজী নন। পুনর্জন্ম হয়েছে মোতিরা আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে নয় মোতি, এখন সে মোতিকুমারী শকসেনা, ব্রজবিলাস শকসেনা, সিনিয়র অফিসরের একমাত্র মেয়ে।