শুধু মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈ চমকে উঠতেন। আগুন জ্বলে উঠত মাথায়। যখন দু’ একজন গানের ওস্তাদ, আশপাশের দু’একজন রসিক আদমি মোতিকে আদর করতে করতে বলত, আর কেন আনোয়ারী, এবার মেয়েকে গান বাজনা শেখাতে আরম্ভ করা এখন থেকে শুরু করলে তবে বয়সকালে মা’র মতন মিঠে গলা পাবে, নাম রাখবে লক্ষৌরা।
মুখে আনোয়ারীবাঈ কিছু বলেন নি, কিন্তু মনে মনে শিউরে উঠেছেন মানুষজন সব সরে যেতে বাড়ি খালি হয়ে যেতে মোতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছেন মোতির ঠোঁটে গালে চুমু খেতে খেতে বলেছেন, না, তোকে আমি কিছুতেই এ পথে নামতে দেব না। কিছুতেই না।
মনের ইচ্ছাটা আড়ালে ডেকে মনোহরপ্রসাদকে বলেওছিলেন অনেকবার।
মোতিকে আমি সরিয়ে দিতে চাই এখান থেকে নাচ গান হৈ হল্লা এসব যেন ওর জীবনে কোনদিন না আসে।
মনোহরপ্রসাদ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এ আবার কি কথা! আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে গান বাজনা শিখবে না তো বেনারস গিয়ে মালা জপবে বসে বসে?তীর্থধর্ম শুরু করবে উঠতি বয়সে?
তীর্থধর্ম করবে কেন এ বয়সে সংসার করবো মনের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘর পাতবে।
নিজের ফেলে আসা সাজানো সংসারের কথা ভেবেই আনোয়ারীবাঈ উদগত নিশ্বাস চাপলেন।
ঘর সংসার করবে মেয়ে। তা বেশ, কিন্তু জেনে শুনে চকের আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়েকে কে এগিয়ে আসবে বিয়ে করতে ওড়না ফেলে কে মাথায় ঘোমটা দেওয়াবো দু একজন কাঁচা বয়সের কচি ডানা মেলে সবে উড়তে শেখা ছোকরা হয়তো রাজী হতেও পারে। বিয়ের ভড়ং করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করবে কদিন। তারপর শখ মিটলে কিংবা বাপের দেওয়া মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেলে পালাবে ফেলে মোতিকে। তখন!
কাজটা যে সোজা নয়, তা আনোয়ারীবাঈ ভালই জানেন। আর জানেন বলেই মনোহরপ্রসাদকে ডেকেছেন শলা-পরামর্শ করতে।
একটা উপায় আছে। আনোয়ারীবাঈ এগিয়ে এসে একটা হাত রাখলেন মনোহরপ্রসাদের হাতের ওপর।
কি উপায়?মনোহরপ্রসাদ নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসল।
বার কয়েক ঢোঁক গিললেন আনোয়ারীবাঈ। কপালে জমে ওঠা ঘামের বিন্দু সুরভিত রুমাল নিয়ে মুছে নিলেন, তারপর বললেন, এমন করা যায় না ভাইসায়েব, আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে নয় মোতি ছেলেবেলায় মা-বাপ-হারা কোন অনাথ তিন কুলে দেখবার কেউ নেই! কোন ভদ্রলোক যার ছেলেপিলের সাধ অথচ ভগবান কিছু পাঠান নি কোলে, তেমন কেউ মোতিকে নিতে পারে না? নিজের মেয়ের মতন মানুষ করতে পারে না?
সর্বনাশ, বিলিয়ে দেবেন মেয়েকে! কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে আনোয়ারীবাঈ বাঁচবেন কি করে?
আনোয়ারীবাঈ বাঁচতে চায় না মেয়েকে বাঁচাতে চায়। আনোয়ারীবাঈয়ের গলা ধরাধরা।
মনোহরপ্রসাদ বোঝাতে চেষ্টা করলা ব্যাপারটা আনোয়ারীবাঈ ভাল করে ভেবে দেখুন হঠাৎ উচ্ছাসের ঘোরে এমন একটা কাজ করলে আপসোসের অন্ত থাকবে না। শেষ জীবনে যখন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নামবে, দেহ জরাগ্রস্ত হবে, হাজার চেষ্টাতেও গলায় মিঠে সুর ফুটবে না, তখন এই মেয়েকে আশ্রয় করেই তো বাঁচতে হবে। এরই রোজগারে দিন কাটাতে হবে আর কি অবলম্বন থাকবে?
অবলম্বন? আনোয়ারীবাঈ হাসলেন। করুণ হাসি মনোহরপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললেন, শেষ জীবনে মেয়ের চেয়ে আরো বড় কিছু অবলম্বনের খোঁজ করব ভাইসায়েবা সারাটা জীবন তো ছিনিমিনি খেললাম নিজেকে নিয়ে, তখন মালেকের কথা ভাবব তাঁর হাতেই ছেড়ে দেব নিজেকে
এর ওপর আর কথা চলে না। তবু মনোহরপ্রসাদ একবার শেষ চেষ্টা করল, কিন্তু মোতি থাকতে পারবে আপনাকে ছেড়ে?
আনোয়ারীবাঈ আবার হাসলেন, মানুষের পরমায়ুর কথা কেউ বলতে পারে?হঠাৎ যদি মারাই যায় আনোয়ারীবাঈ, তাহলেও তো আমাকে ছেড়ে থাকতে হবে মোতিকে। হাজার কাঁদলেও আমাকে ফিরে পাবে না। না, ভাইসায়েব, আনোয়ারীবাঈ গলার সুর নরম করলেন, ভেজা ভেজা। স্বর, একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে। মোতিকে আমি এ নরকে বাড়তে দেব না। ওকে কোথাও। সরিয়ে দিতেই হবে। তুলে দিতে হবে কোন ভদ্রমানুষের হাতে।
মনোহরপ্রসাদ ঘাড় নেড়েছিল বটে, কিন্তু কোন সুবিধা করতে পারে নি।
আনোয়ারীবাঈ ভোলেন নি কথাটা। গান-বাজনার শেষে ক্লান্ত দুটি চোখ তুলে সেই এক মিনতি জানিয়েছিলেন মনোহরপ্রসাদকে। আর দেরি নয়, মেয়ে বড় হচ্ছে। বুঝতে শিখছে। যা কিছু করতে হয়, এই বেলা গাছ একটু বড় হয়ে গেলেই তাকে ওপড়ানো মুশকিল। মাটির গভীরে চলে যায় শিকড়, ডালপালা বিস্তৃত হয় দিকে দিকে, তখন টানাটানি করতে গেলে ক্ষতিই হয়। লক্ষ্ণৌতে সে রকম কেউ না থাকে, মনোহরপ্রসাদ আশপাশে ঘুরে দেখুক। ঘোরবার সব খরচ আনোয়ারীবাঈ দেবেন, কিন্তু আর দেরি নয়।
বরাত ভাল মনোহরপ্রসাদের। এদিক ওদিক ঘুরতে হয়নি কাছেপিঠেই খোঁজ পাওয়া গেল সুন্দরবাগে নতুন এক ভদ্রলোক এসেছেন, স্ত্রীকে নিয়ে। যে বাড়িতে উঠেছেন, সেই বাড়িওয়ালা মনোহরপ্রসাদের দোস্ত। কথায় কথায় ব্যাপারটা তার কাছ থেকেই জানা গেল।
ভদ্রলোক সরকারের বড় চাকরে। সারা ভারতবর্ষে চাকরির অন্ন ছড়ানো ঘুরে ঘুরে সেই অন্ন খুঁটে তুলতে হয়। বছর তিনেক পর বদলি হন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। পয়সাকড়ি, ইমানইজ্জত সব আছে, কেবল সুখ নেই। বছর চারেকের ফুটফুটে একটি মেয়ে ছিল, আজমগড়ে দুদিনের জ্বরে মেয়েটি শেষ। চিকিৎসার সুযোগও পাওয়া গেল না। সেই থেকে ভদ্রলোকের স্ত্রী অনবরত কাঁদেন আর বুক চাপড়ানা অভিশাপ দেন ভগবানকো ভদ্রলোক এসব কিছু করেন না। অফিসের সময়টুকু ছাড়া চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন দরজা জানলা বন্ধ করে।