—তুমি কিছুমাত্র দ্বিধা না করে আমাকে সকলের কাছে চোর বলে চালিয়ে দিলে কী মনে করে?
–ভুল হয়েছিল বলেই তো?
-এ একটা হাস্যকর কথা, ধনীদের সস্তা অজুহাত।
–বললামই তো, ভুল।
–আবার সেই কথা! ভারতী উষ্ণ হয়ে বলল, এই যে সকলে চোর বলেই জানল, আমার দারিদ্রের সুবিধা নিয়ে অনেক ধারণাই করল, তার কী হবে, কী কৈফিয়ৎ দেবে তুমি? আমাদের আত্মসম্মান নেই? না, সেটা তোমার ওই পেন্সিলকাটা জাপানি কলের চেয়ে সস্তা?
–এখন ব্যাপারটা যখন সত্যি নয়—
–সত্যি নয় কে বললে? এখন কারোর কাছে গিয়ে আমি যদি বলি, প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি মেয়ে আমার বন্ধু ছিল, এমন ভাব বোধহয় কোনোখানেই দেখা যায় না। কিন্তু একদিন একটা হার চুরি যাওয়ায় সেই মেয়েটিই আমাকে চোর বলতে একটু ভেবে দেখল না, অমনি আমার কথা বিশ্বাস করবে বল? আমাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে।
ভারতী রাগে লাল হয়ে বলল, আমার সাথে তুমি কথা বোলো না। ঘৃণা জিনিসটা আমি খুবই ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন একটু দরকার বোধ করছি।
সে আর কিছু না বলে জায়গা ছেড়ে চলে গেল।
ইঁদুর
আমাদের বাসায় ইঁদুর এত বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। তাদের সাহস দেখে অবাক হতে হয়। চোখের সামনেই, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলের সুচতুর পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়ার মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়, দেয়াল আর মেঝের কোণ বেয়ে-বেয়ে তরতর করে ছুটোছুটি করে। যখন সেই নির্দিষ্ট পথে আকস্মিক কোনো বিপদ এসে হাজির হয়, অর্থাৎ কোনো বাক্স বা কোনো ভারী জিনিসপত্র সেখানে পথ আগলে বসে, তখন সেটা অনায়াসে টুক করে বেয়ে তারা চলে যায়। কিন্তু রাত্রে আরও ভয়ংকর। এই বিশেষ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ আমাদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু হয়ে যায়। ঘরের যে কয়েকখানা ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স কেরোসিনের অনেক পুরোনো টিন, কয়েকটা ভাঙা সিঁড়ি আর কিছু মাটির জিনিসপত্র আছে, সেখান থেকে অনবরতই খুটখুট টুং টাং ইত্যাদি নানা রকমের শব্দ কানে আসতে থাকে। তখন এটা অনুমান করে নিতে আর বাকি থাকে না যে, এক ঝাঁক নজদেহ অপদার্থ জীব ওই কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপর এখন রাতের আসর খুলে বসেছে।
যাই হোক, ওদের তাড়নায় আমি উত্যক্ত হয়েছি, আমার চোখ কপালে উঠেছে। ভাবছি ওদের আক্রমণ করবার এমন কিছু অস্ত্র থাকলেও সেটা এখনও কেন যথাস্থানে প্রয়োগ করা হচ্ছে না? একটা ইঁদুর মারা কলও কেনার পয়সা নেই। আমি আশ্চর্য হব না, নাও থাকতে পারে। আমার মা কিন্তু ইঁদুরকে বড়ো ভয় করেন। দেখেছি একটা ইঁদুরের বাচ্চাও তাঁর কাছে একটা ভালুকের সমান। পায়ের কাছ দিয়ে গেলে তিনি চার হাত দূর দিয়ে সরে যান। ইঁদুরের গন্ধ পেলে তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন, ওদের যেমনি ভয় করেন, তেমনি ঘৃণাও করেন। এমন অনেকের থাকে। আমি এমন একজনকে জানি যাঁর একটা মাকড়সা দেখলেই ভয়ের আর অন্ত থাকে না। আমি নিজেও জোঁক দেখলে দারুণ ভয় পাই। ছোটোবেলায় আমি যখন গোরুর মতো শান্ত এবং অবুঝ ছিলাম, তখন প্রায়ই মামা বাড়ি যেতুম বিশেষত গভীর বর্ষার দিকটায়। তখন সমুদ্রের মতো বিস্তৃত বিলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে বর্ষার জলের গন্ধে আমার বুক ভরে এসেছে, ছই-এর বাইরে এসে জলের সীমাহীন বিস্তার দেখে আমি অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছি, শাপলা ফুল হাতের কাছে পেলে নির্মমভাবে টেনে তুলেছি, কখনো উপুড় হয়ে হাত ডুবিয়ে দিয়েছি জলে, কিন্তু তখনি আবার কেবলি মনে হয়েছে, এই বুঝি কামড়ে দিল!—আর ভয়ে-ভয়ে অমনি হাত তুলে নিয়েছি। সেখানে গিয়ে যাদের সঙ্গে আমি মিশেছি, তারা আমার স্বশ্রেণির নয় বলে আপত্তি করবার কোনো কারণ ছিল না, অন্তত সেরকম আপত্তি, আশঙ্কা বা প্রশ্ন আমার মনে কখনো জাগেনি।
সেই ছেলেবেলার বন্ধুরা মাঠে গোরু চরাত। তাদের মাথার চুলগুলি জলজ ঘাসের মতো দীর্ঘ এবং লালচে, গায়ের রং বাদামি, চোখের রংও তাই, পাগুলি অস্বাভাবিক সরু-সরু, মাঝখান দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা, পরনে একখানা গামছা, হাতে একটা বাঁশের লাঠি, আঙুলগুলি লাঠির ঘর্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। তাদের মুখ এমন খারাপ, আর ব্যবহার এমন অশ্লীল ছিল যে আমার ভিতর যে সুপ্ত যৌনবোধ ছিল, তা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে উঠত, অথচ আমি আমার স্বশ্রেণির সংস্কারে তা মুখে প্রকাশ করতে পারতাম না। তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত। আমার মুখ লাল হয়ে যেত। তাদের মধ্যে একজন ছিল যার নাম ভীম। সে একদিন খোলা মাঠের নতুন জল থেকে একটি প্রকান্ড জোঁক তুলে সেটা হাতে করে আমার দিকে চেয়ে হাসতে-হাসতে বললে, সুকু, তোমার গায়ে ছুঁড়ে মারব?
আমি ওর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম, ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল, আস্তে আস্তে বুদ্ধিমানের মতো দূরে সরে গিয়ে বললাম, দ্যাখ ভীম, ভালো হবে বলছি, ভালো হবে না। ইয়ার্কি, না?
ভীম হি-হি করে বোকার মতো হাসতে হাসতে বললে, এই দিলাম দিলাম—
সেদিনের কথা আজো মনে পড়ে, ভীমের সাহসের কথা ভাবতে আজও অবাক লাগে। অনেকের এমন স্বভাব তাকে—যেমন অনেকে কেঁচো দেখলেও ভয় পায়। আমি কেঁচো দেখলে ভয় পাইনে বটে, কিন্তু জোঁক দেখলে ভয়ে শিউরে উঠি। এসব ছোটোখাটো ভয়ের মূলে বুর্জোয়া রীতিনীতির কোনো প্রভাব আছে কি না বলতে পারিনে।