খিলখিল করিয়া মালা হাসিয়া ফেলিল।
নিজের দিকে টানিয়া শঙ্কর বলিতে লাগিল : চোর ধরেছি, এখন থানায় খবর দিতে হবে। এখন কোথায় যাবি, চোর? চোর ধরেছি, চোর।
চারিদিকে চাইয়া মালা বলিল, বারে, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলেছি। বারে।
শঙ্কর হাসিতে লাগিল, কিছুতেই ছাড়িবে না।আরও চুরি করবি, আরও?
–বারে, ছাড়ো।
শঙ্কর হাসিতে লাগিল।
হঠাৎ ছুটিয়া গিয়া আবার কিছুদূরে দাঁড়াইয়া মালা বলিল, দাও না?
এবার শঙ্কর কোঁচড়টা ভালো করিয়া খুলিয়া দিল—নে নিয়া যায়।
মালা জানে এখন তাহার চোখে যে চাউনি, সেখানে আগের দুষ্টুমি নাই তাই নির্ভয়ে অগ্রসর হইল।
শঙ্কর নাকে-মুখে ছাড়িতে লাগিল ধোঁয়া।
একটি দুটি নয়, দশ দশটা সিগারেট! ব্যাটারা ভারী সস্তা দেয় তো!
তখন অনেক রাত্রি। চারিদিক নিস্তব্ধ।
আড় হইয়া শুইয়া হাসিতে হাসিতে মালা বলিল, ভারী বাবু হয়ে গেলে যে গো।
নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়িয়া শঙ্কর বলে, ওটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস, তোর জন্যেই তো বাবু হই মালা।
–আমার জন্যে? অন্যমনস্কভাবে এই কথা বলিয়া মালা ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে চাহিয়া রহিল।
তারপর হঠাৎ এক কান্ড।
শঙ্কর বলিল খাবি?
-কী? মালা আশ্চর্য। জ্বলন্ত সিগারেটটি তাহার মুখের কাছে বাড়াইয়া শঙ্কর বলিল, খা?
মালা এবার না হাসিয়া আর পারে না। খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, আমিও তাহলে বাবু হয়ে যাব নাকি গো?
–বাবু নয় বিবি।
–বিবি? প্রথম আস্তে তারপর খুব জোরে এক টান দিয়ে মালা সিগারেট ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল, কাশিতে কাশিতে বালিশে মুখ গুজিল।
শঙ্করও হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে ডাকিল, মালা।
-কেন গো?
তাহার মুখের উপর আরও ঝুঁকিয়া পড়িল শঙ্কর, ডাকিল মালা?
তখন রাত শেষ হইয়া আসিয়াছে। একটু শীত শীত করে। শঙ্করের হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া গেল, দম যেন তাহার বন্ধ হইয়া আসিতেছে। মাথার ভিতর বোঁ বোঁ করে, সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়িয়াছে, তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিল সে। খামোখাই নদীর ধারে সে গিয়াছিল আর দেখা দিয়াছিল নৌকা, সে তো যাইতে চায় নাই, তবু তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইয়াছিল।
হাত-পা তাহার দারুণ হিম হইয়া আসে, শঙ্কর আর একটু নড়িতে পারে না। এতটুকুও নড়িতে পারে না, এতটুকু শক্তি তাহার শরীরে এখন নাই। তবু তো দেখা দিল সেই মস্ত নৌকা, আর সেই মিশকালো রঙের ষন্ডাগুণ্ডা মাঝিগুলি তাহাকে জোর করিয়াই উঠাইয়া লইল। এখন জোর করিয়াও নিঃশ্বাস ফেলিতে কষ্ট হয় তাহার : কানাই মিথ্যা বলে না, সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে সেই লোকটাকে—সে ও তেমনি মরিতে বসিয়াছে নাকি। সত্যি তো তাই; চেষ্টা করিয়াও শঙ্কর উঠিতে পারিল না। চীৎকার করিতে গেল, পারিল না, গলার স্বরও আজ ভয়ে পালাইয়াছে। নইলে সে চীৎকার করিয়া বলিত : মালা, ও মালা, স্বপ্ন দেখে আমি মরছি, আর তুই বেঘোরে ঘুমুচ্ছিস? হারামজাদী, শীগগির আয় বলছি! আমায় মরতে দেখে তোর খুব হাসি পাচ্ছে না! এলি!
শঙ্কর কাঁদিয়া ফেলিল, চোখের জ্বলে-তাহার বুক ভাসিয়া গেল।
—নৌকায় সে তো যাইতে চায় নাই, তবু তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইয়াছিল!
চারিদিকে ভয়ংকর নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কেবল কুকুরের ডাক শোনা যায়।
মালার ঘুমটা একটু বেশিই বটে, সে এখনও বেঘোরে ঘুমাইতেছে।
মড়া পোড়ানোতে সাহায্য করিতে আর মালাকে এই দুঃসময়ে সান্ত্বনা দিতে পরদিন সন্ধ্যায় কানাই, বৃদ্ধ আদিনাথ, আরও অনেকেই একবার আসিয়াছিল।