-বারে, খাব! অনেকদিন পরে আব্দুলের সঙ্গে যখন দেখা হল, বললাম, আজ দুধ যা হয় দিয়ে এসো। আব্দুল,যা লাগে দেব। ভাবলাম, গাই আমাদের কবেই বা বিয়োবে, কবেই বা সে দুধ খাব? তাই কিনলাম। ভালো করিনি।
মাথা নাড়িল মালা।
—দুদিনের জন্যে সংসারে আসা, কেন খামোকা কষ্ট করতে যাব? কষ্ট করে লাভ? আজ বাদে কাল যাব মরে; কেউ থাকবে না জীবন সম্বন্ধে পরম দার্শনিক হইয়া উঠিল শঙ্কর, বলিল, তবু কষ্ট করে লাভ পরাণটাকে দুঃখু দিয়ে লাভ! চাচা আপন পরাণ বাঁচা! নিজের রসিকাতায় নিজেই হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল শঙ্কর, কিন্তু কতোটুকু হাসিয়াই আর পারিল না। আপন পরাণ বাঁচা! কেন? সে কী মরিতে চলিয়াছে নাকি? কে বলে সে মরিবে? লোকটা কে? কেন?
ইস কী রোদ! মাথা ঘুরাইয়া দিয়ে যেন!
শঙ্কর তাড়াতাড়ি দাওয়ায় গিয়া বসিল, হাত-পা তেমনি অসাড় হইয়া আসিতেছে, যেন বাকি নাই তাহার। রৌদ্রে খাঁ খাঁ করিতেছে সামনের উদ্যানটি গাছপালা সব নেশায় বুদ, উহাদের পাতায় পাতায় ঝিম ঝিম। নেহাত কিছু না হইলে মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে আর এরূপ বদলায় না। মালা তাহার কান্ড দেখিয়া আশ্চর্য হয়, আগের মতো তেমন কথা বলে না, কেবল চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, চোখ দুটি মাঝে মাঝে দারুণ কাতর হইয়া ওঠে, কিন্তু কী খাওয়া রে বাপু! দিন নাই রাত্রি নাই—কেবল খাওয়া। দুইজনে তাহারা আর কত খাইবে! এই তো লইয়া আসিয়াছে সেদিন এক মস্ত বোয়াল মাছ, মালা সারা জীবনেও অমন একটা আস্ত বোয়াল আর দেখে নাই, দেখিয়া সে তো অবাক, সেটা কেমন করিয়াই বা কুটিবে, অত মাছ দিয়া কী-ই-বা করিবে।
কলেরার মতো অসুখ আর আছে! শঙ্কর কোনোরকমে দেহ রক্ষা করিয়া ভাবে : অতি বড়ো শত্রুরও যেন তেমন অসুখ কখনো না হয়। অথচ দ্যাখো প্রত্যেক বছরই এ গাঁয়ে তা হওয়া চাই। মজা মন্দ নয়। যাতে না হয় সেই তথ্য কী তাহারা জানে না, ইহাও আবার বলিয়া দিতে হইবে নাকি? এই তো দ্যাখো বাপু, আমার কিছুই হয় নাই, আমি সেই আমিই আছি—কেন! সেই তথ্য কী তোমাদের একবারও জানিতে ইচ্ছা হয় না? আমি সেই আমিই আছি। নিজের প্রতি চাহিয়া শঙ্কর একবার না হাসিয়া পারে না। কিন্তু হইতে কতক্ষণ! শঙ্করের মুখের হাসি মুখেই মিলাইয়া যায় : কিন্তু হইতে কতোক্ষণ! আজ না হয় কাল হইবে। কাল না হয় পরশু! সময় তো উত্তীর্ণ নয়, স্বপ্নে যার সূচনা, তার শেষ নিশ্চয় আছে। সেই শেষ কখন আসিবে কে জানে। তার আসিবে ঠিক, কানাইদা মিথ্যা বলে না। অত কথার প্যাঁচ কেন বাপু? মৃত্যু, অর্থাৎ আমি মরিব—এই তো বলিতে চাও।
কে একজন আসিয়া খবর দিল ওপাড়ার দীননাথ গিয়াছে মারা। সেই বৃদ্ধ দীননাথ, বুড়া বলিয়া সম্বোধন করিলে যে লোকটা লাঠি লইয়া দৌড়াইয়া আসিত। যা মুখে আসে তাই বলিত। সেই দীননাথ গিয়াছে মারা, মড়া পুড়াইতে লোক দরকার, সে যাইবে না কী?
এতখানি বলিবার সাহস যার আছে, তাহাকে খুব একচোট মার দেওয়াই উচিত, গায়ে শক্তি থাকিলে শঙ্কর তাহাই করিত। কিন্তু উঠিবার মতো শক্তিও তাহার কোথায়? এতটুকু নড়িতে পারিতেছে না, মাথায় হাত দিয়া দেখিল, সেখানে আগুনের তাপ। শঙ্কর চেঁচাইয়া উঠিল, মড়া পোড়াতে এ গাঁয়ে আর লোক নেই, আমায় কেন? ভারী দায়ে ঠেকেছি আর কি? বুড়ো যখন মরেছে, সম্পত্তি তো আর আমি পাব না, যারা পাবে তাদের গিয়ে বলগে, যা; আমার এখানে কেন? যা এখান থেকে—দীননাথ মন্ডলের মড়া পুড়ালে চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার হবে আমার। ভারী তো দায় ঠেকেছে।
মালা তো অবাক।
দুইদিন পরে কথা। সেদিন হাটবার। এ অঞ্চলে এখানকার হাটই সব চেয়ে বড়ো৷ ভোর হইতে নৌকা ভিড়িতে থাকে, দুপুর বেলা হাট জমে। অজস্র লোক সমাগমে সেদিন সমস্ত গ্রামখানা গম গম করিতে থাকে।
একবার হাট করিয়া দিয়া শঙ্কর সেদিন খুব ঘুরিয়া বেড়াইল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া কত জিনিসই খাইল। তেলেভাজা, জিলিপি, বেগুনি, ফুলুরি—সে আরও অনেক খাইয়াছে বটে, আজকার মতো আর কোনোদিনও এত ভালো লাগে নাই তো, চমৎকার। পেট ভরিয়া শঙ্কর সেগুলি খাইল, কোঁচড়ে ভরিয়া আরও কয়েক পয়সার লইতে ভুলিল না। তারপর এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট কিনিয়া একটি টানিতে টানিতে যখন বাড়ির পথে রওনা দিল, তখন বিকাল। সবচেয়ে ভালো লাগে বেগুনি, বাড়ি গিয়া একটা সিগারেট জ্বালাইয়া শঙ্কর কোঁচর খুলিয়া বসিল, বাঃ, এদিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়িয়া খাইতে তো আরও চমৎকার।
দেখিয়া মালার জিহ্বার জল, লোভ আর সে সামলাইতে পারে না। হাত পাতিয়া বলিল, আমায় দাও না?
বিস্ময়ে শঙ্কর তাহার দিকে চাহিল, মনে হইল, মালা যেন কোনো একান্ত পরনির্ভর শিশু, আর সে তার প্রভু; মনে হইল, এমনভাবে যেন মালা তাহার কাছে কোনোদিন কিছু চায় নাই। শঙ্কর দেখিল, অল্প ঘোমটার ছায়ায় মালার দুই চোখ কোনো নূতন রহস্যে ভরা।
-আমাকে দেবে?
মুচকি হাসিয়া শঙ্কর বলিল, কেন দেব? তুমি কে?
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া মালা বলিল, দাও না?
–ইস তুই আমার কে, যে তোকে দেব?
–দাও না।
আবার মুচকি হাসিয়া শঙ্কর সিগারেট আর বেগুনি নিজের মনে খাইতে লাগিল। মালা দেরি সহিতে পারে না, যা চায় তা না পাইলে তাহার সয় না হঠাৎ নীচু হইয়া সে শঙ্করের কোঁচড়ে হাত দিয়া ফেলিল, আরে আরে—আর অমনি শঙ্কর ধরিয়া ফেলিয়াছে।