-কেন ডাকছো? আমি তোমায় ডাকতে বলেছি নাকি? কেন আমার ঘুম ভাঙালে? ঘরে খিল দিয়ে জন্মের মত ঘুমুতে পারিসনি? কেন আবার দরদ দেখাতে এলি?
মালা ভয় পাইয়া গেল, শঙ্করের এমন মূর্তি সে কখনো দেখে নাই। একদমে অতগুলি প্রশ্ন করিয়া শঙ্কর আবার স্তব্ধ হইয়া গেল, মাটির দিকে চাহিয়া রহিল, কী এক অজানা ভয়ে সর্বাঙ্গ তাহার অবশ হইয়া আসিতেছে!
—আমায় ডাকনি কেন?
শঙ্কর আবার জ্বলিয়া উঠিল : হারামজাদি, ডাক দিইনি—কে বললে? ডেকে ডেকে হয়রান হয়েছি, তবু সাড়া দিসনি, নাক ডেকে ঘুমিয়েছিস! কেন এত হেলা ফেলা? তোর আমি সোয়ামি নই নাকি? হারামজাদি, যা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে–
চুপ করিয়া স্কুল ভর্ৎসনা শুনিবার মতো স্বভাব মালার নয়, রাগিয়া বলিল, একা একা বাড়ি পাহারা দেব কেন, আমার ভয় করে না বুঝি? আর এমন রাতবিরেতে বাড়ি ফিরবেন, তার জন্যে দরজা খোলা রেখে ভূতের মতো বসে থাকব আমি, ভারী মজা রে! যেন আমি একটা মানুষ নই, আমার চোখে ঘুম নেই! আরও কী যেন বিড় বিড় বকিতে বকিতে সশব্দ পদক্ষেপে মালা চলিয়া গেল। তেমনি মাটির দিকে চাহিয়া শঙ্কর বসিয়া রহিল, ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া তাহার এমন কি কথা বলিবার শক্তিও যেন নাই। এই তো শেষ রাতে একটু ঘুম আসিয়াছিল, তাতে আবার কী স্বপ্ন-ভাবিতেও সারা শরীর ভয়ে অসাড় হইয়া আসে। কানাই যা বলিয়াছে, তা সত্যি? সত্যি হইলে তো—শঙ্করের চিন্তার পথ রুদ্ধ হইয়া আসে। সে তো যাইতে চায় নাই, তবু জোর করিয়া লইল। কোথা হইতে আসিল নদী, কোথা হইতে আসিল নৌকা, আর সে-ও বা কী করিয়া ঠিক সেখানেই গিয়া পড়িল, আর যত যন্ডা-গুণ্ডা মাঝিগুলি জোর করিয়াই তাহাকে নৌকায় উঠাইয়া লইল, সে তো যাইতে চায় নাই। এখন সে মরিবে, এ তো জানা। ওমা গো, ওদিকে যে কলেরা। লাগিয়াছে সারা গাঁয়ে। ভয়ে আরও সংকুচিত হইয়া গেল শঙ্কর।
জল আনিতে গিয়া মালা ভাবিল, অন্যায়টা তাহার নিজেরও কম হয় নাই। সারারাত একটা লোক বাহিরে কাটাইয়াছে, শুধু তাহারই দোষে। এই ঘুমের জন্য তাহাকে আরও যে কত কষ্ট পাইতে হইবে, তাহা সে ছাড়া আর কেহ বলিতে পারে না। তা ছাড়া শুনিলে লোকেই বা কী বলিবে? ঘর থাকিতে অমনভাবে সারারাত বাহিরে কাটাইতে কার না রাগ হয়, শঙ্করেরও বা দোষ কী? মনটা হয়ত আজ কিছু খারাপ কিন্তু সেই বা কেমন করিয়া অতশত বুঝিতে পারে? ওরকমভাবে গালমন্দ করিলে কার না রাগ হয়? আজ কত বছর হইল বিবাহ হইয়াছে, অন্য স্বামীর মতো হাত তোলা দূরের কথা, একদিনের জন্যে একটু তিরস্কারও শঙ্কর তাহাকে করে নাই। এই লইয়া মনে মনে সে কত গর্ববোধ করে, সমবয়সি বন্ধুদের কাছে সালঙ্কারে বলিয়া বেড়ায়, অথচ তাহাদের স্বামীরা, সে তো শুনিয়াছে, তাহাদের কাছে এমন অনেক কিলটা-লাথিটা সকলেই আশা করে। নিজের বিচারে মনে মনে অপরাধ স্বীকারের গৌরবে মালার দুটি অভিমান কাতর চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
বাড়ি গিয়া বলিল, কী হয়েছে তোমার আজ? মনটা ভালো নেই জানি, কেন বলবে?
শঙ্কর তেমনি মাটির দিকে চাহিয়া আছে একদৃষ্টে, কোনো উত্তর দিল না, কেবল মুখটি একবার উঠাইয়া তাহার দিকে ক্ষণেক চাহিয়া আবার নীচের দিকে তাকাইয়া রহিল। কলেরা যার নাম, ওরে বাবা! জীবনের প্রদীপটি সেখানে নিরাশার তাকে তুলিয়া রাখিতে হয়! তাহার এই জীবনেই সে কম দেখিয়াছে নাকি? সেই ব্যারামের কবলে পড়িয়া আবার সারিয়া উঠিয়াছে, এমন তো মনে পড়ে না। তাহার এখন উপায়? সত্যিই কী সে মরিতে চলিয়াছে? একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিল শঙ্কর : না, কলেরা তো তাহার হয় নাই; কিন্তু আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু তো হইতে পারে? তখন ঠেকাইবে কে? কেহ না। কার সাধ্য বাধা দেয়। সে যাইতে চায় নাই, তবু তাহাকে জোর করিয়া উঠাইয়া লইল! আর ভাবিতে পারে না শঙ্কর। এখন উপায়? কলেরার দিনে পেট খালি রাখিতে নাই, একথা সে কার মুখে যেন শুনিয়াছে। পেটে ক্ষুধা রাখিতে নাই? এখনও তো খায় নাই সে!
শঙ্কর উঠিয়া দাঁড়াইল।
–কোথায় যাচ্ছো?
–আমায় খেতে দিবিনে? আমার খিদে পায় না?
অন্য সময় হইলে নিজের কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিকতায় নিশ্চয় বিস্মিত হইত শঙ্কর।
—সে কী দেব না কেন? রাতেও যে খাওয়া হয়নি।
—বলতে লজ্জা করে না? তুই বেশ খেয়ে আছিস, আর আমি খাইনি; তুই আমায় খেতে দিসনি-লজ্জা করে না বলতে?
শুধু বলিতে কেন, এবার প্রতিবাদ করিতেও মালার লজ্জা করে, দুঃখ হয়, নিজের উপর রাগ হয়।
পরম তৃপ্তি সহকারেই শঙ্কর অনেকগুলি বাসি ভাত তরকারি খাইল, (ডাক্তারের নির্দেশে তো নানারকম খাদ্যাদির জাতি নিরূপণে কোনো ভেদাভেদের প্রশ্ন তাহার কাছে নাই, অথবা থাকিলেও কেহ তাহাকে সে কথা বলে নাই, তাহার কী দোষ, সেসব কথায় কে কান দিতে যায়!) যাই বলো মালাটা রাঁধে ভালো।
মালা বলিল, তোমার খুব খিদে পেয়েছিল, না?
সজোরে মাথা নাড়িয়া এই প্রথম একটু হাসিতে গিয়া শঙ্কর কী জানি কেন হাসিতে পারিল না।
অন্যদিনে বাড়ি ফিরিতে বেলা দুটা—আড়াইটার কম হয় না, কিন্তু আজ শঙ্কর বারোটার আগেই ফিরিল। মালা রাঁধিতেছিল, উনানের আঁচে মুখ তাহার রাঙা ঘর্মাক্ত।
রান্নাঘরে উঁকি দিয়া শঙ্কর বলিল, আব্দুল এসেছিল?
তাহাকে এই অসময় আসিতে দেখিয়া মালা তো অবাক, কিন্তু সে বিস্ময়ের ভাব চাপিয়া বলিল, হ্যাঁ। কিন্তু কেন এসব!