কিছুক্ষণ পরে কানাইর নীরব হাসি থামিয়াছে। সুতরাং, আশা করা যায়, এবার কিছু সে বলিবে। আর বলিল ঠিকই।—তারপর, বুঝলে মামা, ঠিক এমন সময় স্বপ্নটা গেল ভেঙে আর তার কদিন পরে লোকটা মারা গেল।
–মারা গেল!
–হ্যাঁ সামান্য জ্বর হয়ে মারা গেল। নৌকোর স্বপ্ন এমনি খারাপ। কেউ একবার দেখলে তো রক্ষে নেই, বুঝতে হবে, একদিনের মধ্যেই তার ভবলীলা শেষ।
শ্রোতার দল ভয়ে স্তব্ধ। পরস্পরের প্রতি চাহিবার সাহসও আর নাই! স্বপ্নে নৌকা দেখিলে আর রক্ষা নাই, দু-একদিনের মধ্যেই মৃত্যু! সেই লোকটার মৃত্যুর সাক্ষী ওই বয়োবৃদ্ধ কানাই নিজে, তা ছাড়া বইতেই যে লেখা আছে। অথচ এখন কানাই—কী রকম হাসিয়া হাসিয়া আলাপ করিতেছে দ্যাখো, যেন কিছু হয় নাই তাহার, ভয় বা অস্বস্তির চিহ্ন মাত্র নাই।
শঙ্কর বলিল, কানুদা, লোকটা মারাই গেল? কানাই তখন অন্য কথা বলিতেছে, শুনিতে পায় নাই। উত্তর দিল আদিনাথ, শঙ্করের দিকে চাহিয়া বলিল, দূর।
অর্থাৎ তোমরা ছেলেছোকরার দল এসব বিশ্বাস করবে কেন?
আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লাগিয়াছিল, শঙ্করের মনেই। সারাক্ষণ সে প্রায় চুপ করিয়া শুনিয়াছিল, উঠিয়াও আসিল নিঃশব্দেই। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, চারিদিকে পিটপিটে অন্ধকার, বাতাসের শন শন শব্দ। দুইপাশে ঝোপঝাড়, গাছপালা, অন্ধকারের সঙ্গে উহাদের পার্থক্য ধরা যায় অল্প। একটি আলো দেখা যায় না কোথাও। সাপ-টাপ পড়িয়া থাকে, অন্ধকারে পা ফেলিয়া শেষে কামড় খাইয়া মরা–নাঃ এত রাত করাটা ভালো নয়। মালা হয়তো শঙ্কায় রাত্রি জাগিতেছে, নাঃ এত রাত! কিন্তু এত রাত কী সে আর ইচ্ছা করিয়া করে? কে জানে, নৌকার স্বপ্ন অত খারাপ! ইস লোকটা মারাই গেল শেষে।
তাহার বাড়ি যাইতে একটা জায়গা আছে, খুব নীচু, উঁচু আলে পথ সংকীর্ণ, শঙ্কর সেখান দিয়াই পথ হাঁটিতেছিল। বর্ষাকালে এখানে জল হয়, এমন কী নৌকা চলাচল করে—নৌকা? স্বপ্ন দেখিতেছে না তো! নিজের চোখে মুখে গায়ে একবার হাত বুলাইয়া দেখিল শঙ্কর। না, স্বপ্ন নয়; ভাবিতেছিল শুধু। চাহিয়া দেখিল, দুইপাশ খালি, কোনো ঝোপ-ঝাড় নাই, পায়ের নীচে পথের সঙ্কীর্ণতা অনুভব করা যায়।
বাড়ির একেবারেই কাছে আসিয়া পড়িয়াছে, কোথা হইতে কান্নার রোল ভাসিয়া আসিতেছে শোনা গেল। কে মারা গেল কে জানে! যে কলেরা আরম্ভ হইয়াছে, এবার গ্রামশুদ্ধ উচ্ছন্ন করিয়া দিবে। কোন সময় কার পালা আসে কে বলিতে পারে। সাপের দেহের মতো পিচ্ছিল নিস্তব্ধ রাত্রি, গাঁয়ে চৈত্রের বাতাসে আজ কান্নার সুর।
মালা ঘুমাইয়াছিল। কয়েক ডাকেও উঠিল না। মেয়েটা অমনি ঘুম কাতুরে, বেহুশ হইয়া ঘুমায়। এখনও শিশুসুলভ অভ্যাসটি যায় নাই, কোনোদিন যাইবে কি না সন্দেহ। অন্যদিন হইলে শঙ্কর কতো ডাকাডাকিই করিত। দরজা ধাক্কাইয়া, চেঁচাইয়া, তারপর দরজা খুলিলে একটা যা-তা কান্ড করিয়া ছাড়িত। মালা তাহার সেই বর্বরতাকে বরং ভালোবাসে, তাই বুঝি তাহার জন্য অপেক্ষা না করিয়া সকাল সকাল ঘুমায়। কিন্তু আজ শঙ্করের কী জানি কেন ভালো লাগিল না, আর ডাকাডাকি না করিয়া দাওয়ার মেঝেতে নিজের গামছাখানা পাতিয়া এক ছোটো পিঁড়ি শিয়রে লইয়া শুইয়া পড়িল! একটা পরেই না হয় ঘরে গিয়া শোয়া যাইবে। চৈত্রের বাতাস হা হা করে নারকেল গাছে শির শির শব্দ। মুঠা মুঠা অন্ধকারের রাশি শঙ্করকে ঘিরিয়া ধরিল। শঙ্কর ভাবিতেছিল…কয়েকদিন পরেই চৈত্র সংক্রান্তি, সেই উপলক্ষে যে বিরাট মেলা হয় পলাশপুরে, তেমন মেলা নাকি এ অঞ্চলে আর হয় না। এবার যাওয়া যাইবে বাহিরে, মালার অনেক দিনের ইচ্ছা। কিন্তু নৌকা? নৌকা সে পাইবে কোথায়? ও পাড়ার সরকাররা তো প্রত্যেকবারই যায়, নেহাত ধরিয়া পড়িলে তাহাদের দুজনের একটু জায়গা দিবে নাকি! দুইজন বৈ তো নয়! তাহাদের যে প্রকান্ড বড় ছয় মাল্লার নৌকা—নৌকা? দূর! কানাইদার ওটা গল্প, ওরকম স্বপ্ন তো সে কতোই দেখিয়াছে, দূর! নাঃ, নৌকার স্বপ্ন তো সে কোনোকালেই দেখে নাই, দেখিলে নিশ্চয়ই মরিত, তখন কোথায় থাকিত ওই মালা, কোথায় থাকিত এই ঘর বাড়ি। কিন্তু লোকটা? লোকটা মারাই গেল শেষ পর্যন্ত? সামান্য জ্বরে আবার মারা যায় নাকি কেউ? আর সামান্য জ্বর! কপালে ছিল মৃত্যু, কে ঠেকাইবে তা? নৌকা না, তেমন স্বপ্ন সে কখনো দেখে নাই, কানুদা মিথ্যা বলে না, দেখিলে নিশ্চয় সে মরিত। দূর তাহার আবার ভয় কেন? কস্মিনকালে স্বপ্নই সে দেখে না, তা—আবার—দূর!
তখনও খুব ভালো করিয়া ভোর হয় নাই। ঘুম ভাঙিলে শঙ্করকে পাশে না দেখিয়া মালা আশ্চর্য হইল; কাল রাতের কথা তাহার মনে পড়িল—শঙ্কর আর বাড়ি আসে নাই। কী বুদ্ধি দ্যাখো, আমাকে একা ফেলিয়া-মালার রাগ হইল : এমন লোক লইয়া সংসার করা যায় না, নিজের স্ত্রীকে যে একা ঘরে ফেলিয়া বাহিরে কীর্তনের আসরে রাত কাটায়, তাহার সঙ্গে ঘর করা যায় না—মালা একজন পাকা গৃহিণীর মতো বুদ্ধিমতী হইয়া উঠিল। কিন্তু বাহিরে আসিয়াই দুই চক্ষু স্থির। এবার হইল ভয়; হঠাৎ কী করিবে ভাবিয়া পাইল না। কিছু পরে অত্যন্ত সাহসে ভর করিয়াই তাহার গায়ে হাত দিয়া ডাকিল, কতো ঘুমুচ্ছ? ওঠো? আর কত ঘুমুবে?
—হুঁ? কে? ধড়মড় করিয়া উঠিয়া শঙ্কর মালার দিকে চাহিল।