অদূরে গেটম্যান গেট বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
এখনই গাড়ি আসিবে বোধ হয়। ইষ্টিশনে প্ল্যাটফর্মে কুলিদের অল্পবিস্তর ব্যস্ততাও চোখে পড়ে। দূরে যাদবদের যে সারি সারি কোয়ার্টার দেখা যায়, একটি। দীর্ঘ খেজুর গাছের নীচে তাহাদের নিতান্তই নিরীহ বলিয়া মনে হয়।
হাসি থামিলে সুকুমার আবার বলিল,
-আবার এমনি আর একটা লোককেও দেখেছিলাম, যাকে একদিন দেখি ছোটো ছোটো ছেলেপিলেরাও ঢিল ছুঁড়ে মারেছে!
—ঢিল ছুঁড়ে মারছে!
–হ্যাঁ!—সুকুমার আবার তেমনি হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।
এমন সময় এক কান্ড ঘটিল।
শঙ্কর হঠাৎ চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল,
—যাদবদা, সিগারেটটা ফেলে দাও, ফেলে দাও বলছি! সকলে বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে যাদবের দিকে তাকাইল।
শঙ্কর আবার বলিল, ওটা আর খেয়ো না, খেয়ো না, ফেলে দাও বলছি! শঙ্করের চোখে মুখে আতঙ্ক, স্বর উত্তেজিত।
যাদব হতভম্বের মতো সিগারেটটা নীচে নামাইয়া বলিল, কেন?
শঙ্কর বলিল, দেখছো না, ওটা কেমন হয়ে গেছে, কী যেন বেয়ে পড়ছে।
সকলে দারুণ আতঙ্কে জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে চাহিয়া দেখিল : হ্যাঁ ঠিকই কেমন একটা বিশ্রী কালো পদার্থ সিগারেটটার বাকি অংশটুকুর গা বাহিয়া পড়িয়াছে। যাদবও দেখিল, হাতের আঙুলগুলি তাহার ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপিতেছে।
শঙ্কর বলিল, ওটা বিষ।
–বিষ!
-হ্যাঁ, বিষ। মুখে গেলে আর বাঁচতে হবে না।
আমি এক সাহেবকে দেখেছি তারও এমনি হয়েছিল, কী যেন পড়ছিল সিগারেটের গা বেয়ে, সে অমনি ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। যাদবদা, ওটা খেয়ে না, ফেলে দাও বলছি— ছুড়ে ফেলে দাও!
যাদব আর দ্বিরুক্তি করিল না। সিগারেটটা দূরে ছুঁড়িয়া মারিল। হাতটা তাহার এখনও কাঁপিতেছে।
কিন্তু সিগারেটটা?
অর্ধেক খাওয়া হয় নাই যে! যাদবের মনটা খারাপ হইয়া গেল, সে চুপ করিয়া রহিল।
লাইনের কিছু দূরে দীর্ঘ ঘাসে-ভরা মাটিতে সিগারেটটা জ্বলিতেছে, আর সেই দীর্ঘ ঘাসের-ভিতর হইতে একটা সাদা মসৃণ ধোয়ার রেখা পাকাইয়া-পাকাইয়া উপরের দিকে উঠিতেছে। মনে হয়, লকলকে ঘাসের ওই তীক্ষ্ণ ডগাগুলিও সিগারেটের ধোঁয়ার বিষে জর্জরিত; তাই কম্পমান।
স্বপ্ন
ঠাণ্ডাটা আজ একটু বেশিই পড়িয়াছে, বাহিরেও কনকনে বাতাস, বেড়ার ফাঁক দিয়া সে বাতাস আসিয়া সকলের গায়ে লাগে। একপাশে একটি কুপি জ্বলিতেছে—প্রচুর ধোঁয়ায় মেশানো, লাল শিখা। বাতাসে কড়া তামাকের গন্ধ। রাত এখন ক-টা হইয়াছে কেহ বলিতে পারে না। মাঝে মাঝে কেবল কুকুরের ডাক ছাড়া গভীর নিস্তব্ধতা চারিদিকে।
কলকে উপুড় করিয়া আর এক ছিলিম তামাকের আয়োজন করিতে গিয়া কানাই দেখিল, কৌটাতে তামাক নাই। হাতের কাছেই ভেজানো দরজার দিকে চাহিয়া বলিল, একটু তামাক দে তো রে, দামি?
দামিনী কানাইর মেয়ে। কেবলমাত্র বাবার মুখের অদ্ভুত গল্পটার আকর্ষণেই এতরাত অবধি জাগিয়াছিল। বলিল, তামাক তো নেই বাবা!
—সে কী, কালই না অতগুলো পাতা কাটলাম? খাওয়ার মালিক যদিও কানাই একাই, তবু সে আশ্চর্য না হইয়া পারিল না। সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও ভয়েরও তাদের সীমা নাই : আহা, অমন গল্পটি মাটি হইয়া যাইবে।
কিন্তু দামিনী রক্ষা করিয়াছে। কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া এক ছিলিমের উপযোগী তামাক আনিয়া বাবার হাতে ফেলিল। মেয়েটার বুদ্ধি আছে!
বিষয়টা আগে কী ছিল বলা যায় না, বর্তমানে স্বপ্নতত্ত্বে পরিণত।
অবশেষে হুঁকাটি বৃদ্ধ আদিনাথের হাতে বাড়াইয়া দিয়া কানাই বলিল, ওরকম স্বপ্ন কখন দেখে বলো দিকি মামা? সব কিছুই ফলবে কেন? হাতের পাঁচটা আঙুল কী সমান? আমরা যে বাপ-দাদা চোদ্দো পুরুষ ধরে চাষ করে আসছি, সব সময়েই কী ভালো ফসল পাচ্ছি? তেমনি, যা দেখবো তাই ফলতে হবে, ওরকম যে বলে, সে একটা আস্ত বোকা ছাড়া আর কী, তোমরাই বলো! আরে বাপু, এ যে আমার আর তোমার মুখের বানানো কথা নয়, এমন-এমন বই আছে যে গো! তাতে ফলাফল আছে স্পষ্ট। যা লিখেছে সব সত্যি, কিছু মিথ্যে হবার নয়, এতটুকু মিথ্যে হবার নয়।
নিমীলিত চক্ষু আদিনাথ সায় দিল—দূর? মিথ্যে কেন হবে? যা লিখেছে সব সত্যি। তাহলে আমি একটা বলি শোনো। সেবার—মনে মনে সকলে শঙ্কিত হইয়া উঠিল : তোমারটা এখন থাক মামা, পরে শোনা যাবে। কানাইদা তারপর কী হল?
আদিনাথ বলিল, দূর!
চারদিকে চোখ বড়ো করিয়া চাহিয়া কানাই বলিল, তারপর লোকটা নদীর পারে এসে দাঁড়ালো, হুঁ, এখন পার হবে কী করে? মহামুশকিল! অথচ সেখানে বসে থাকলেও চলবে না, পার হতে হবে! কী আর করা, বসে রইল। সময় যায়– সময়ান্তরে কানাইর একটা অভ্যাস, দু-মিনিট বলিয়া চার মিনিট বিশ্রাম করা —এমনভাবে সে কথাটি বলিয়াছে, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, নৌকো!
-হ্যাঁ। লোকটা চেঁচিয়ে বললে, ও মাঝি, আমার পার করে দেবে? মাঝি বললে, পারব না। দাও না একটু? না না, আমাদের অনেক কাজ, নলহাটির হাটে ভোরবেলাতক না পৌঁছুলে চলবে না। দাও না গো। এই ভর সন্ধ্যেয় ঠেকেছি বলেই না! পয়সা দেবে? হুঁ মাঝি বললে কি না পয়সা দেবে? তা ছাড়া আর উপায় কী? সে বললে, দেব। তখন তো পারে ভিড়ল এসে। আর—উপসংহার করিবার মতো অত্যন্ত নীচু স্বরে কানাই বলিল, আর লোকটা গিয়ে উঠল সেই নৌকোয়।
সব চুপচাপ! কেউ একটি কথা বলিতেছে না। সকলেই তাহার মুখের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল। বুঝি কানাইর এই বিরতি আর সহিতে না পারিয়াই একজন বলিয়া উঠিল, তারপর? কানাইর মুখে এবার হাসি—বাঁ দিকের চোখটি ছোটো হইয়া আসিয়াছে, বাঁ দিকের গালে রেখা আঁকিয়া গিয়াছে। সকলে জানে এ ধরনের হাসি তাহার খারাপ। সেই উপসংহারের কথা কানাই কখন বলিবে কে জানে। কাটা আর একজনের হাতে দিয়া বৃদ্ধ আদিনাথ বলিল, দূর!