ঠাকুরমার চোখের জল তখন শুকিয়ে এসেছে।
ব্যাপার আরও অনেকদূর গড়াত যদি না মনোরমা জানতে পারত। হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে মন্টু অনেক অস্পষ্ট কথা বলে বালিশে মুখ ঘষে গোঙাচ্ছে। অনেক কষ্টে সেদিন তাকে সেই গোঙানি থেকে বাঁচানো গেল, তার পরের দিন মন্টুর যা চেহারা হয়ে গেল দেখলে কান্না পায়। আর সর্বদাই কেমন পাকিয়ে পাকিয়ে তাকায়, যেন সর্বদাই ভয়ে হিমসিম খাচ্ছে। সন্ধ্যা হলে অবস্থা আরও জটিল। তখন সকলেই মনোরমার আঁচল ধরে বসে থাকে, কিছুতেই ছাড়বে না।
পরদিন মনোরমা সত্যবতীর ঘরের দিকে ছুটে গেল। সত্যবতী তখন জয়ন্তীর দৈহিক দুর্দশার কথা নিয়ে ঝি মতির মা-র সঙ্গে গভীর আলাপে রত। মনোরমা বলল, আপনি এসব কী শুরু করে দিয়েছেন শুনি? ছেলেপিলে বলে একবার মায়াও হয় ন? আমাদের কি মেরে ফেলবেন?…এতটুকু মান-সম্মান জ্ঞান নেই? গেঁয়ো ভূত।
–ভূত।
সত্যবতী অবাক হয়ে মনোরমার দিকে চাইল, তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। যে-কোনো মুখভঙ্গিতেই তাকে এমন বিকৃত দেখায়, যেন মনে হয় সর্বদাই সে রেগে রয়েছেঃ চোট-পড়া কপালের নীচে জলভরা চোখ দুটি বাঘের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে। ওপরের পাটির কালো দুটি দাঁত নীচের ভারী ঠোঁটের গায়ে বারে বারে আঘাত খেতে থাকে, যেন একটা কালো চকচকে মেশিন; হাঁসফাঁস করে চলেছে, দম আটকে রেখে মাঝেমাঝে শ্বাস ফেলছে।
তারপরে এক পরিচ্ছন্ন ভেরবেলায়—বাড়ির একটা লোকও তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, কিন্তু দূরে বড়ো রাস্তায় ট্রাম-বাসের শব্দ প্রবল হয়ে উঠেছে—সত্যবতী তার কালো ইস্পাতের মতো শরীরে একখানা নামাবলি জড়িয়ে মাথায় নববধূর মতো প্রকান্ড ঘোমটা টেনে, নিজের ছোটো পুঁটলিটা কাঁধে স্থাপন করে পথে বেরিয়ে পড়ল। এমন দুঃসাহসিকতার অভিনয় সে তার জীবনে আরও অনেক করেছে, স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রামের বিপুল শক্ৰসংখ্যার সঙ্গে একা যখন যুদ্ধ করেছে। তখন আত্মরক্ষার্থে কতো দুঃসাহসিক কাজে তাকে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। আজও তার অন্যথা হতে পারে না। রাজপথে পড়ে, সত্যবতী যাকে কাছে পেলে তাকেই জিজ্ঞেস করলো-হ্যাঁ গা, শেয়ালদায় কত নম্বর বাস যায় বলবে?
এমন কোলাহল-ভরা রাজপথে সত্যবতীর কণ্ঠস্বর ভারী ক্ষীণ শোনা গেল। সে বাসের কন্ডাকটরদের জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁগো, তোমাদের বাস শেয়ালদায় যাবে?
সিগারেট
যাদব ঠিক করিল সে আজ একটা সিগারেট খাইবে। বিবাহের আগে মাঝে-মাঝে দু-একটা সিগারেট সে খাইত বটে, কিন্তু তারপর এতগুলি বছর আর চুঁইয়াও দেখে নাই, আজ ঠিক করিয়া ফেলিল, যত দামই হোক, সিগারেট আজ একটা সে খাইবেই।
বড়ো রাস্তার রেলওয়ে ক্রসিং-এর গেটের সঙ্গে লাগোয়া যে ছোটো দোকানটা বসে, সেখানে সবরকম সিগারেটই থাকে। যাদব ধীরে ধীরে সেদিকেই চলিল। গিয়া দেখিল, দোকানের মালিক গোকুল সেখানে নাই, হয়তো খাইতে গিয়াছে, একট ছোঁড়া বসিয়া আছে সেখানে। পান সাজানোর চকচকে থালাটার উপর দুটি পয়সা ঝনাৎ করিয়া ফেলিয়া যাদব বলিল, একটা গিসারেট দে তো?
যুদ্ধের ফলে সব সিগারেটের দামই চড়ে গিয়েছে, ছোঁড়াটা বলিল।
তা হোক, যাদব তবু একটা সিগারেট কিনিয়া ফেলিল, অত্যন্ত সাবধানে সেটা দুই ঠোঁটের মাঝখানে চাপিয়া সে তা ধীরে ধীরে ধরাইয়া জোরে একটা টান দিল, তারপর কিছুদূর হাঁটিয়া দেখিল, রেলওয়ে ক্রসিং-এর ওইদিকে লাইনের পাশেই শীতের রৌদ্রের নীচে খোলা জায়গাটিতে গোল হইয়া বসিয়া মাধু সর্দার, ইয়াসিন, শঙ্কর আর সুকুমার গল্প করিতেছে, তাহাদের আজ দুপুর বেলা কারুরই ডিউটি নাই।
সিগারেট-মুখে যাদবকে দেখিয়া তাহারা সকলেই একসঙ্গে হৈ হৈ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল।
ইয়াসিন বলিল, আরে মস্ত বাবু হয়ে গেলে যে যাদববাবু! শঙ্কর বলিল এসব কী? বুড়ো-বয়সে আবার ফুর্তি জাগল কেন?-বুড়া যদিও যাদব এখনও হয় নাই, তবু তাহাকে এমন একটি কথা শঙ্কর না বলিয়া পারিল না।
সুকুমার রেলওয়ে ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সে বলিল, তাই তো বলি যাদববাবু কোথায় গেল? ইউনিয়ন অফিসে একেবারেই পাত্তা নেই কেন? আপনার ওপর কী ভার দেওয়া হয়েছিল, মনে আছে তো?
একসঙ্গে কতকগুলি ধোঁয়া নিয়া যাদব হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসির সঙ্গে সঙ্গে রুদ্ধ ধোঁয়াগুলি কুন্ডলী পাকাইয়া বারে বারে তীব্র বেগে বাহির হইয়া আসিতে লাগিল।
আর সকলেই বিড়ি খাইতেছে।
তাহার সিগারেটের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া তারপর সুকুমার বলিল, এই সিগারেট দেখে আমার তিরিশ সালের কথা মনে পড়ছে। সে আরম্ভ করিল, তখন গান্ধী বিলিতি-বর্জনের আন্দোলন আরম্ভ করেছেন। আর কি, সে সময় তো এদেশের ধনীদের পোয়াবারো। তাদের ব্যাবসা দিন দিন কেঁপে উঠল, তার লভ্যাংশ দিয়ে তারা নতুন ব্যাবসা খুলল। এদিকে দিশি কতরকম বিড়ি যে বেরিয়ে গেল তার হিসেব নেই। যারা কোনদিন সিগারেট ছাড়া খান না, তারাও বিড়ি খেতে আরম্ভ করলেন, তখন কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে, তার ওপর এমন ঘেন্না হত যে তা বলবার নয়, ইচ্ছে হত, বিলিতি-বর্জনের মতো তাকেও বয়কট করি, বা জ্বালাময়ী ভাষায় খুব কয়েকটি কথা শুনিয়ে দিই!—সুকুমার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, প্রাণ ভরিয়া কিছুটা হাসিয়া নিয়া আবার সে বলিল, তখন আমি একটা লোককে জানতাম যার স্বভাবই ছিল, সকলে যা করত তার ঠিক উল্টো করা। সকলে যদি ঠিক করল, হরতাল করবে, সে অমনি বাজার করে আসত। সবাই ঠিক করল, এবার বিলিতি আর পরবে না, অমনি দেখা গেল খাঁটি বিলিতি কাপড়ের জামা পরে দিব্যি সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেমনি সবাই যদি ঠিক করল সিগারেট আর খাবে না, চেয়ে দ্যাখো সে দারুণ সিগারেট খেয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এবার আর কিছুতেই রেহাই পাবার জো-টি নেই। তাকে সিগারেট খেতে দেখে সবাই তাকে বয়কট করলে, এমনকি, কথা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হল, সত্যি এমন শাস্তি আর দেখিনি! সুকুমার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, প্রাণ ভরিয়া হাসিতে লাগিল।