সকলে অবাক। মনোরমা হতবুদ্ধি।
সত্যবতী বিনিয়ে বিনিয়ে বলল, হে মা কালী, ছেলেকে আমার ভালো করে দাও। আমার রাজু ভালো হলে জোড়া পাঁঠা বলি দেব, আমার ছেলেকে ভালো করে দাও! এতদিন ধরে এসেছি, মার সঙ্গে দেখা করবার নামটি নেই, আমার ওপর রাগ করবে না তো কি? মাগো, তোমার কাছে কত অপরাধই না করেছি, তাই বাছার আমার এমন অসুখ করেছে। তোমার দুটি পায়ে ধরি মা, বাছাকে আমার ভালো করে দাও! সত্যবতীর দু-চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, চোখের জলে বুক ভেসে গেল। কান্নার বেগ খানিকটা কমলে সে সকলকে এই বলে আশ্বাস দিল যে মা কালীর কৃপায় সে তার রাজুর অসুখ একঘণ্টার মধ্যে সারিয়ে দেবে।
সত্যবতীর এই উচ্ছাসে কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ না করে সকলে যে যার কাজে মন দিল, মনোরমা তার দিকে একবার তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে তারপর স্বামীর প্রতি মৌখিক পরিচর্যার শর নিক্ষেপ করল।
রাজকুমার ওঠার চেষ্টা করে বলল, আহা, এত গোলমাল কেন? কিছু হয়নি, তোমরা যাও, আমায় একটু একা থাকতে দাও, উঃ! রাজকুমার তার কপালে হাত চেপে চুপ করে বসে রইলেন।
কিন্তু এমন অবজ্ঞা কখনো সহ্য হয়? সত্যবতী ভাবলো, সে যে কালী পেয়েছে, একথা কে না জানে?
বরং একথা শুনে এ বাড়ির লোকগুলি হয় খিলখিল করে হাসবে, নয়তো গম্ভীর হয়ে বসে থাকবে। বিশ্বেস করতে যেন অহংকারে বাধে। অথচ এইজন্যই গ্রামে তার কতো আদর, তাকে নিয়ে কত ডাকাডাকি, কত লোক ডাক্তারকে ফেলে রাজুর মা-র কাছে ছুটে আসে। অথচ এরা বিশ্বেস করে না। কলিকাল না হলে এমন হয়! সত্যবতী মনে মনে দারুণ বিরক্ত হল; এত বিরক্ত হল যে মনে মনে এদের প্রতি ঈশ্বরের অভিশাপ কামনা করতে লাগল। যারা অহংকারে মত্ত হয়ে লোককে এমন অবজ্ঞা করে, তাদের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। সত্যবতী ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। এখনি রান্না করে কিছু খেতে হবে তো! পেট যখন আছে তখন পেটের ভিতর কিছু দিতেই হবে।
বাইরে একটা কাক ডেকে উঠল, কা! কী!
সত্যবতী তাড়া দিয়ে বলল, আ-মর! আবার এখানে এসে পড়ে মরেছিস কেন? যা, এখান থেকে যা। হুশ, হুশ! এদের দেখলে সত্যবতীর বুকের ভিতর কাঁপুনি ধরে যায়।
বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে মন্টু এসে হাজির, সঙ্গে বেলা-হেলা-জিতুরাও। মন্টু বলল, ঠাকুমা, আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন। আমাদের স্যার আজ বলেছেন ভূত বলে কিছু নেই।
সত্যবতী অবাক হয়ে গেল। দু-চোখ পাকিয়ে বলল,-ষাঢ় কে শুনি!
—আমাদের ইংরিজি যিনি পড়ান, আমায় খুব ভালোবাসেন। বলেছেন ভূতটুত কিছু নেই?
—হ্যাঁ?
সত্যবতী ঠোঁট উলটিয়ে বলল, …কথায় বলে.., কিন্তু হঠাৎ দারুণ গম্ভীর হয়ে গেল। নিজের দু-চোখে আঙুল দিয়ে বলল, আমি এই স্বচক্ষে দেখেছি। তাহলে বলি শোন।
সবাই তাকে ঘিরে বসে গেল, বেলা ঠাকুরমার বিছানার ওপর হাঁটু গেড়ে বসল। সত্যবতী তার তোবডানো বিকৃত মুখ আরও বিকৃত করে বলল, আমি স্বচক্ষে দেখেছি!…।
দু-বছর আগের কথা বলছি। সেবার একটা পাখি আমার ঘরের উঠোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাখিটা দেখতে এমন সুন্দর ছিল যে কী বলব, দু-চোখ জুড়িয়ে যায়, মনে হয় আরও দেখি। দেখতে পেলুম, পাখিটা রোজই আমার উঠোনে এসে বসে, দু-হাতে রূপের হাট খুলে এদিক-ওদিক হাঁটে। দেখতে দেখতে ভারী ইচ্ছে হল ওকে একবার ধরি। পাখিকে ইচ্ছে হলেই হাত বাড়িয়ে ধরা যায় না, তবু কেন ইচ্ছে হল ওকে একবার ধরি। অমনি হাত বাড়িয়ে দিলুম, হাত বাড়িয়ে দেখি পাখি তো উড়ে পালিয়ে গেল না, কেবল একটু সরে দাঁড়াল। ভাবলুম এমনটি তো কখনো হয় না। আবার হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলুম, পাখি আবার সরে দাঁড়াল। আবার ধরতে গেলুম, আবার সরে দাঁড়াল! বুঝলি মন্টু, আমি যেন পাগল হয়ে গেলুম, পাগলের মতো ওর পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলুম— সত্যবতীর চোখ বড়ো হয়ে গেল, সে তার গলার স্বর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে বলল, অনেকক্ষণ পর চেয়ে দেখি, আমি একটা বনের মধ্যে এসে পড়েছি, আর আমার সামনে সেই পাখি, বনের মধ্যে একটা জনমানব নেই, ঘর নেই, বাড়ি নেই, আমার হাত-পা অবশ হয়ে এল, আমি কাঁদতে লাগলুম। সত্যবতী সত্যই কেঁদে ফেলল, তার দু-চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। মন্টুদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। ভয়ে তাদের দাঁতগুলি যেন লেগে গিয়েছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে। সত্যবতী বলল, একটু পরেই চেয়ে দেখি, পাখির জায়গায় পাখি তো নেই, শাদা কাপড় পরে এত বড় ঘোমটা টেনে এক বউ, বউ আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এল, আমার তখন পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে, আমি তখন বুদ্ধি করে এক দৌড় দিলুম, তারপর অনেকদূর এসে তারপর বাঁচলুম। আবার বলে কি না বিশ্বেস করে না। বিশ্বেস তোর মাষ্টারের ঘাড় করবে। তোদের মাষ্টারের ভারী অহংকার হয়েছে, না রে? সত্যবতী আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছল।
সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ কারোর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, মন্টু তো চোখ বুজেই রইল, একজন যে উঠে সুইচ একটু টিপে দেবে, এমন সাহসও কারোর নেই। মন্টু চোখ বুজেই বললে, আলোটা জ্বালিয়ে দে না বেলি? ইস, কী অন্ধকার! আলোটা জ্বালো না? আমি পারব না বলছি। নিজে যেতে পারো না? হেলার অবস্থা আরও সাংঘাতিক। সে দাঁতমুখ খিচিয়ে অনেক কষ্ট করে যতোই ভূতের চেহারাটা ভুলতে চেষ্টা করছিল ততোই সেই ভূত নামক জীবটি একটা বিরাট আকার ধারণ করে তার চোখ ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল। সে অবশেষে কাঁদতে শুরু করে দিল : ঠাকুমা, ও ঠাকুমা!