-ঠাকুরমা ভয় করছে যে।
–ভয় কীসের? ভারী তত ভয়! কয়লার টুকরোর মতো কয়েকটি দাঁত বের করে সত্যবতী হাসে।
মন্টু বয়োজ্যেষ্ঠ। সকলের বড়ো হয়ে পাছে নিজের দুর্বলতা অতর্কিতে প্রকাশ পায় এই ভয়ে সে নিজের চঞ্চল দৃষ্টি যথাসম্ভব গুটিয়ে ওপরে যেতে যেতে বিজ্ঞের মতো বলল,-ভয় কীসের? আমার হাত ধরে চলে আয় হেলা।
বেশি রাত হয়নি। রান্নাঘরে এখনও রান্নার আয়োজন চলছে। বাসন আর খুন্তি নাড়ার টুং-টাং শব্দ, ঝি-চাকরের চেঁচামিচি, ওপরে ইন্দুর পড়া মুখস্থ করা, মনোরমার ছেলের ঘরে প্রথমে যে ছেলেটি রয়েছে তার অবিশ্রান্ত চীৎকার। মেয়েটা বড়ো কাঁদে। মনোরমার বড় ছেলে বাইরে অনেক রাত কাটায়, বড়ো ফ্লাস খেলার বাতিক, বাতিক শুধরে যাবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শোধরাল কই? ওদিকে দোতলার রেলিং বেয়ে কয়েকটা কাপড় ঝুলছে, বেশিরভাগই শাড়ি। আশ্চর্য, এত লোক-লস্কর থাকতেও এমন ব্যাপার! কেবল পড়া মুখস্থ করলে আর গান শিখলেই হবে? সত্যবতী একটা প্রকান্ড হাই তুলল, সঙ্গে সঙ্গে দুটি আঙুল দিয়ে টকটক শব্দ করে তুড়ি দিতে ভুলল না। তার হাই দেওয়ার অর্থ এই নয় যে সে এখনি ঘুমুতে যাবে, এমনি ঘন ঘন হাই তোলা তার একটা অভ্যাস; তাতে সে বেশ আরাম বোধ করে। সত্যবতী উঠে দাঁড়াল, ঘোমটা টেনে বাইরে গিয়ে থপ থপ করে ওপরে উঠতে লাগল, সিঁড়ি এত প্রশস্ত এবং বেশি যে যেন একটা মরুভূমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে—অস্ফুটস্বরে সে বলল, কত সিঁড়ি বাপু, যেন আর ফুরোবে না?
দোতলার পেছনের ছাদে কে এই রাতে ঘুরে বেড়োচ্ছে? কাছে গিয়ে দেখা গেল, জয়ন্তী। মরা ঘাসের মতো শুকনো জয়ন্তী এই রাত্রেও দিব্যি চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সত্যবতী আশ্চর্য হয়ে বলল, ওমা গো, এই অমাবস্যার রাত্তিরেও চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? তোদের কান্ড দেখে গা বমি বমি করে, জানিস, রাত্তিরে চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ালে কী হয়?
জয়ন্তী অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে একট মধুর বিষয় ভাবছিল, এমন নির্মম আঘাত পেয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে চাইল, কিন্তু দেখল, তার দুটি চোখ আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে।
সত্যবতী হতাশ হয়ে বলল, ওমা গো, আমি কোথায় যাব? তার খারাপ লাগল এই ভেবে যে, দিনকালের গতি আগের মতো আর নেই ঠাকুর-দেবতা তো মানবেই না, এমনকী অমাবস্যার রাত্রেও যে চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ানোটা মোটেই ভালো নয়, এ-ও মানবে না। এই তো সেবারও ঘোষবাড়ির পারুল—সে বলবে সেই ঘটনা? আর বললেও তো বিশ্বাস করবে না। সত্যবতী নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে নীচে নেমে এল, তখুনি দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সকালে ঘুমালে যা হয় তার কি, মধ্যরাতে জেগে উঠে সত্যবতী বাইরের বারান্দার কার জুতোর মচমচ আওয়াজ শুনতে পেল, বললে, কে? কে? কিন্তু কোনো উত্তর নেই। জুতোর আওয়াজ সিঁড়িতে উঠে আবার আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। মনোরমার বড়োছেলে প্রিয়কুমার এতক্ষণে বাড়ি ফিরছে।
পরদিন সুদীর্ঘ এক ঘণ্টাকাল পর বারান্দা ধরে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় এমন একটা ঘটনা ঘটলো যাতে সত্যবতী একটা তুমুল কান্ড বাধিয়ে তুলল। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, ঝি মতির মা-র কাপড়ের আঁচলটা তার সদ্যস্নাত শরীরে হাওয়ার মতো একটু এসেছিল মাত্র, সত্যবতী অমনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, আ-মর মাগী, ছুঁয়ে দিলি যে? কেন ছুঁয়ে দিলি বল? ওমা গো, আমি এইমাত্র চান করে এলাম, আর অমনি ঝি-মাগী আমায় ছুঁয়ে দিল, আবার বলে কি না, আমরা ছোটোলোক নই গো, অদেষ্ট মন্দ বলেই আজ ঝি-গিরি করে খাই! বলে কি না কায়েত, কায়েত না আরও কিছু, ও-কথা বললেই আমি বিশ্বাস করি!
মতির মা বিশেষ শ্রদ্ধা সহকারেই বৃদ্ধির পায়ে ধরে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু এমন ঝামটা খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল, এবারের মতো নিজের জাতের উচ্চতা আর বিশেষ প্রমাণ না করেই ধীরে ধীরে সরে পড়ল।
কিন্তু প্রমাণ করতে না দিলেও এমন অবজ্ঞাও আবার সহ্য হয় না। সত্যবতী একে নিতান্ত অবজ্ঞা বলেই ধরে নিল। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো আরও ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
এমন সময় দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে মনোরমা বলল, আহা অত চেঁচামেচি কেন? বাড়ির মধ্যে একটা অসুখ হলেও এক মিনিট শান্তিতে থাকবার যো নেই? তোমরা সবাই মিলে কি ক্ষেপেছো? ইন্দু ওখানে দাঁড়িয়ে কেবল হাসছিস যে? এলি? রতন, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছিস? ডাক্তার ডাকতে গেলি?
-ডাক্তার! আবার ডাক্তার ডাকা কেন? কার আবার অসুখ করেছে? সত্যবতী খানিকটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে গেল, মনে মনে ভাবল, কার আবার অসুখ হল? মনে হচ্ছে তার রাজুরই কিছু? সত্যবতী অমনি তার বর্তমানের বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত রেখে একটি তেজস্বিনী ঘোড়ার মতোই ছুটতে ছুটতে ওপরে গিয়ে হাজির হল, শুনতে পেল রাজকুমার বলছে :
-আমি আর কী করব বল? এক ছেলে জুয়ো খেলেন, আর এক ছেলে স্বদেশি করেন, আর এক মেয়ে বিয়ে করতে চান না, আর এদিকে তো ভাঁড়ার ঘর শূন্যি, ঋণে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছি। লোকে তাদের ছেলেপিলে আশা কেন করে! বুড়ো বয়সে অকর্মণ্য হয়ে গেলে বসে বসে খাবে বলেই তো? আর আমার ঘরে এসব কী?
সত্যবতী বুঝতে পারল, রাজকুমার কিছুক্ষণের জন্য ভারী অস্থির হয়ে পড়েছে। হবেই তো! এতবড়ো একটা সংসার ওই একটা লোকের মাথায়ই তো। সত্যবতী ঘরের ভিতর ঢুকে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল, বললো, রাজুরে, তোর এ কী হল বাবা? আমায় আগে বলিসনি কেন? শত হলেও তো আমি তোর মা, মা-র কাছে সব কথা আগে বলতে হয়।