সত্যবতী রাজকুমারের পিতা নবকুমারের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, তার বিবাহের ইতিহাস বড়াই বিচিত্র। রাজকুমারের মা মারা যাওয়ার বছর পাঁচেক পরে হঠাৎ একদিন ভয়নাক বাবু সেজে নবকুমার কোথায় উধাও হয়ে গেল, সাত-আটদিন পরে সঙ্গে করে নিয়ে এল এই দুর্ধর্ষ সত্যবতীকে। সত্যবতী তখনও এমনি কালো বটে, কিন্তু কিছুটা মার্জিত, চকচকে, হঠাৎ দেখলে চোখ ঝলসে যায়। তার প্রকান্ড শরীর তখন দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, ধূ-ধূ করে। নবকুমার তখন সেই রসসিক্ত শরীরটাকে পেয়ে চুলে প্রচুর কলপ মেখে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিল।
কিছুকাল পরে আবিষ্কার করা গেল, সত্যবতী কেবল সত্যবাদীই নয়, কিঞ্চিৎ মুখরাও বটে। গ্রামের ভিতর তার শক্ৰসংখ্যা হু-হু করে বেড়ে যেতে লাগল, সত্যবতী নিঃসংশয়ে একটা সিদ্ধান্ত করল যে, সমস্ত পৃথিবী তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারপর অনেকগুলি বছর কেটে গেছে এবং সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একলা সংগ্রাম করে এতকাল বেঁচে থাকা যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় বটে। নবকুমার এই স্ত্রীলোকটিকে বিয়ে করবার পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একদিন ভুলেও ছেলের খোঁজ করেনি—লোকে শুনে অবাক হয়ে যায়, বাস্তবিক মানুষ এমন পাগল হয় কী করে? শত হলেও নিজের ছেলে তো? মনোরমার অভিযোগ এইখানেই, তার জ্ব কুঁচকে এসেছে এই কারণেই। সে তার বড়ো মেয়ে জয়ন্তী এবং পুত্রবধু সুনন্দার কাছেই প্রথম ব্যাপারখানা সবিস্তারে খুলে বলল। শেষে এই বলে উপসংহার করল যে, এমন দরদ দেখলে হাসির বদলে কান্নাই পায়।
কিছুক্ষণ পরে ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে এক নতুন বিভ্রাট এসে হাজির। কেমন একটা পচা গন্ধ পেয়ে সত্যবতী নাকে কাপড় দিল, দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল, ঘরের অন্ধকার কোণের দিকটিতে একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে। আ রামো! এমন কান্ড তো জীবনেও দেখিনি। সত্যবতী অমনি দৌড়ে মনোরমার কাছে গেলো, গিয়েই একদমে বললো, বউ, তুমি জেনেশুনে যে এমন একটা কান্ড করবে তা আগে জানিনি।
মনোরমা সেদিনের বাজারের হিসেব লিখছিল। চাকর সামনে দাঁড়িয়ে, চশমাসুন্ধু ভারী মুখখানা তুলে চোখদুটি বরাবর সত্যবতীর চোখের ওপর স্থাপন করে সে বলল, কী হয়েছে?
সত্যবতী হাত-পা চোখ-মুখ সব একসঙ্গে নেড়ে হতাশার সুরে বলল, হবে আর কি! যা হবার তাই হয়েছে। একটা চড়াই মরে পড়ে রয়েছে ঘরে। বউ, তুমি বেছে-বেছে এমন একটা ঘর কেন আমায় দিলে বলো তো? আমার রাজুর তো। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় আর ঘরের অভাব নেই।
মনোরমা বিরক্ত হয়ে বলল কে বললে, আমি আপনাকে ওরকম একটা ঘরে ইচ্ছে করে থাকতে দিয়েছি! এই বলে একজন চাকরকে ডেকে চড়াইটা বাইরে ফেলে দিতে নির্দেশ দিল।
তখনও ভালো করে সন্ধ্যা হয়নি। এই সময়টা সমস্ত বাড়িটা ভোরবেলার গোলমালে ভরে যায়। ঝি উনান ধরাতে যায়, ঠাকুর মনোরমার কাছে এ বেলা কী কী রাঁধবে সে বিষয়ে পরামর্শ করতে আসে, আর বৈকালিক চা-পান এখনও যাদের হয়নি তাদের শিশুসুলভ চীকার বাড়ির ওদিকে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
এমন সময় বারান্দার আবছা অন্ধকারে কয়েকটি ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যবতী উৎসাহিত হয়ে ডাকলো, কে রে! বেলা? শোন।
বেলার দল খিলখিল করে হেসে উঠল, একটা দৌড় দিয়ে খানিকটা পালাবার চেষ্টা করে আবার যথাস্থানে ফিরে এল, বুড়ির দিকে পিটপিট করে তাকাতে লাগল।
—শুনে যা বলছি? আহা, ছেলে-বুড়ো সবাই এরকম! শুনে যা? ছোটো ছেলেমেয়ের দল এবার সাহস করে সত্যবতীর ঘরের ভিতর ঢুকল, দম বন্ধ করে বলল, কেন ডাকছ বুড়ি?
বুড়ি! সত্যবতী এক মুহূর্তে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, তাদের তেড়ে বলল, আমি বুড়ি নাকি? বজ্জাত ছেলে ধরে কান মলে দেব? যার তার সঙ্গে ইয়ার্কি, না?
বোরা আবার দমে গেল, এখন কী করবে ভেবে না পেয়ে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অন্ধকারে ঘুরঘুর করতে লাগল। এ দেখে সত্যবতীর মায়া হল। তাদের ডেকে বলল, ফের ওরকম করিসনি বুঝলি? বুঝলি তো? হ্যাঁ, তোর নাম কী রে? কী বললি? হেলা? সত্যবতী হেলা নামের ছোটো মেয়েটিকে কোলের কাছে টেনে বলল, আচ্ছা হেলা, তোরা কখনো ভূত দেখেচিস?
–ভূত, না।
–আমি দেখেছি! সত্যবতী এমনভাবে হাসল যেন কোনো ভূতের মতোই দেখায়, বলল—শোন তাহলে বলি। সেদিন শনিবার পশ্চিমপাড়ার ঘোষবাড়িতে শনিপুজোর নেমন্তন্ন ছিল, তাই সকাল-সকাল যাচ্ছিলুম। মাত্র সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পথে লোকজন নেই। গাঁ-দেশের পথ-ঘাটের কথা তো জানিস, ক-টা লোকই বা হাঁটে। সে রাস্তা দিয়ে যেতে একটা জায়গা ছিল যেখানে গাছপালা ঝোপ-জঙ্গল এত বেশি যে দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে আসে। বাঁদিকে একটা তেঁতুলগাছ আছে, কবে কোন ঝড়ে উপড়ে পড়ে রয়েছে। তবু আজও মরেনি, বছর বছর দিব্বি পাতা গজায়, তেঁতুল গজায়। এই তেঁতুলগাছের কাছে গিয়েই গা আমার ছমছম করতে লাগল, আমি জোরে হাঁটতে লাগলুম, কিন্তু ভাই পথ আর ফুরোয় না, যতোই হাঁটি না কেন পেছনদিকে চেয়ে দেখি সেই তেঁতুল গাছ। ভাবতে লাগলুম এবার কী করা যায়? ঠিক এখুনি তো মন্তরটা আওড়ানো আর ঠিক হবে না, একবার হারালে ও মন্তর আর ফিরে পাওয়া যায় না, এমন সময় দেখি আমার পথ আগলে সেই–! সত্যবতী মুখে উচ্চারণ না। করে আকারে ইঙ্গিতে বলল, বুকের ওপর থুথু ফেলল-এই প্রকান্ড…তালগাছের মতো তার দুটি ঠ্যাং, মিশমিশে কালো শরীর, ওপরের দিকে ভয়ে চেয়ে দেখলুম, তার গায়ে নেই আমাদের মতো কোনো মাথা, নেই গলা, কেবল বুকের ওপর বড়ো বড়ো দুটি চোখ, আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে! আমি তো ভয়ে হিমসিম খেয়ে গেলুম, শরীরের ভেতর ঘাম দিয়ে জ্বর এল, হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল, …সত্যবতীর ছাইরঙা দুটি চোখ বড়ো হয়ে এল, সে সকলের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সেদিনের ভয়ের ছায়াগুলি আজও তার চোখের সম্মুখে ভূতের মতো ঘুরে বেড়োচ্ছে। আর মন্টুরা? তাদের চোখও বিস্ফারিত, তারা ভয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে সত্যবতীর হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসে রইল। গল্প যখন শেষ হল তখন রাত নটা বাজতে আর বাকি নেই। সত্যবতী অনেক গল্প করল, মুখের জল ফেনা হয়ে গেছে, তার কুঞ্চিত পেটের ঘরখানায় আরও গল্প আনাগোনা করে। সত্যবতী আশ্বাস দিল, সেসব কাহিনি সে আরেক দিন বলবে—আজ আর নয় বাপু, আজ আর নয়!