বৃদ্ধা কারোর আশায় এদিক-ওদিক চেয়ে শেষে একটা চাকরকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি না?
রাজু! রাজু কে! এই বলে চাকরটা আবার নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেল।
রাজু কে! তবে কি এটা রাজুর বাড়ি নয়? বৃদ্ধা মনে মনে খানিকটা অসহায় বোধ করল। কিন্তু বাইরে সে ভাব সম্পূর্ণ ঢেকে রেখে আর একজনকে ডেকে বলল, আচ্ছা, এটা আমাদের রাজুর বাড়ি নয়?
ঝি মতির মা খনখন করে বলল, রাজু-টাজু কেউ এখানে নেই গো।
কিন্তু এমন সময় ভেতর থেকে মনোরমা বললো, কে রে মতির মা? এই বলে আর মতির মার উত্তরের অপেক্ষা না করে ধীরে ধীরে ভারী শরীরখানা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। তার চোখে চশমা, হাতে অনেকগুলি চুড়ি, গায়ে আঁটো সাটো সেমিজ, চওড়া নকশি পেড়ে শাড়ি, বুড়িকে দেখে মনোরমা আশ্চর্য হল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে বিস্ময়ের ভাব দমন করে ফেললে, বরং চোখের ওপর ভ্রূ কুঁচকে এসেছে।
একগাল হেসে সত্যবতী বলল, বউ, কেমন আছো? আচ্ছা তোমাদের কতকল দেখিনে, তোমাদের কথা ভেবে হয়রান হয়ে গেলুম, ঈশ্বরকে কত বলি, ঠাকুর আমার এমন ছেলে, ছেলের বউ, সব থাকতে আমি ষাটের বুড়ি কেন এত কষ্ট করে মরি? ছেলে তো আমার এমন নয় যে কক্ষনো ডাক-খোঁজ করে না, আমার রাজুর মতো ছেলে কারোর হয়? কক্ষনো হয় না, এই আমি বলে দিচ্ছি। এই তো সেবার এক দুই তিন চার, সত্যবতী হাতের কর গুণে বলল, পাঁচটা টাকার জন্যে দু-অক্ষর লিখে পাঠিয়ে দিলুম, আর অমনি তোমায় কী বলব বউ—আর অমনি যেন হাওয়ার গাড়িতে চড়ে টাকা এসে হাজির! বলতে বলতে সত্যবতীর দম বন্ধ হয়ে এল।
ইতিমধ্যেই প্রায় সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল; বাড়ির সমস্ত ছেলেমেয়েরা মন্টু-ঘেন্টু-জিতু-বেলা-হেলা ইত্যাদি সবাই এসে বুড়িকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলের ছোটো জিতু এই কুৎসিত বুড়িকে আর কখনো দেখেনি, সে মনোরমার আঁচল ধরে নাকি সুরে বলল, কে ঠাকুরমা?
সত্যবতী হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে বলল, আই ভাই আয়, তোদের নাম কী রে ভাই? আরে, আয় না? এই রাজকন্যার মতো সুন্দরী বউকে দেখে পছন্দ হচ্ছে না? সত্যবতী একটু পরিহাস করল। ওদিকে মনোরমার শীতলতাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তাকে খুশি করবার জন্যে বলল, তোমাকে ভারী শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে বউ। কোনো অসুখ করেছে বুঝি?
মনোরমা সংক্ষেপে গম্ভীর স্বরে বলল, না, কোনো অসুখ করেনি।
ওপরে পড়ার ঘরে বসে ইন্দু প্রাণপণে কলেজের পড়া মুখস্থ করছিল। নতুন মানুষের সাড়া পেয়ে বারান্দার ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, মা, কে এসেছে?
মা একবার ওপর দিকে চাইলো মাত্র, কিছু বলল না। সত্যবতী চোখ বড়ো করে বলল, বউ, আমি বলে দিচ্ছি, তোমার কোনো অসুখ করেছে, তুমি না বললে আমি শুনব কেন? দাঁড়াও আমি ওষুধ দিয়ে দেব। সত্যবতী বছর দুই আগে নাকি কালী পেয়েছিল, তাঁর আশীর্বাদে একটা মূল্যবান ওষুধও পেয়েছিল এবং সত্যবতী মনোরমাকে অভয় দিল।
মন্টুরা একেবারে হাঁ করে তার দিকে চেয়েছিল, এমন কদাকার চেহারা তারা ইতিপূর্বে আর কখনো দেখেনি। ছবিতেও এরকম চেহারা খুব কম দেখা যায়। দাঁত যা-ও আছে তাও এমন কালো যে দেখলে ঘেন্না করে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে কী যেন পড়ছে।
–কিন্তু ছাইপোড়া কপাল আমার,—সত্যবতী বলা-নেই-কওয়া-নেই হঠাৎ কপালে করাঘাত করে বলল, হা-ঈশ্বর! যার জন্য এতদূর এলাম তাকেই ভুলে গিয়েছি। রাজু কোথায় বউ, আমার রাজু?
মনোরমা বসবার ঘর দেখিয়ে দিল।
সত্যবতী তরতর করে অমনি সেই ঘরের দিকে ছুটল, পুঁটুলিটা কোথাও রাখবার জায়গা এখনো হয়নি, আর রাখবেই বা কোথায়? কোথাও এতটুকু পরিষ্কার জায়গা আছে কি? সেটা কাঁধে করেই সত্যবতী বসবার ঘরে ঢুকল, কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে তার চক্ষু স্থির, আহা কী চেহারা কী হয়েছে গো! ননীর শরীর যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই তকতকে সোনার বরণ রংই বা কোথায়, মাথায় সেই গভীর কালো চুলই বা কোথায়? রাজকুমার চেয়ারে বসে অনেক খাতাপত্র দেখছেন, সামনেই দুটি চেয়ারে বসে আরও দুটি লোক। সেই লোকগুলির সামনেই সত্যবতী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বললে, রাজু, তোর এ কী চেহার, হয়েছে বাবা? তোর এমন অসুখ আমায় আগে জানাসনি কেন? কেন জানাসনি বল? আমি কি তোর কেউ নই? ঈশ্বরকে কত বলি, হে ঠাকুর সবই তা দিয়েছে, তবে আর একটি মনোবাঞ্ছা যদি পূর্ণ করতে! আজ উনি বেঁচে থাকলে।
ব্যাপারটা প্রথমে রাজকুমার ভালো করে বুঝতেই পারেনি। হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। একটু পরে লজ্জায় আর রাগে মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সত্যবতীকে দুহাত দিয়ে ধরে সে বলল, আহা, এখানে কেন মা? এখানে কেন মা? এখানে থেকে যাও, অন্যসময় হবে। সে সত্যবতীকে ঘরের বার করে দিল। সত্যবতী তখনো শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, একহাতে পুটুলিটা ধরে আর এক হাতে কাপড়ের আঁচল দিয়ে নাক-চোখ মুছতে লাগল।
দুর্ধর্ষ শক্তিমান কোনো লোককে কাঁদতে দেখলে যেমন হাসি পায়, এই কুৎসিত বুড়িকে শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মন্টুদের হাসি পেল, তারা খিল খিল করে হাসতে লাগল।
এই দেখে সত্যবতীর রাগের সীমা নেই!
-আহা, হাসছিস কেন? আমরা গরিব বলে মানুষ নই বুঝি?
মনোরমা আর সহ্য করতে পারল না। বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন, কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন ওঘরে, তবু ওখানে গিয়ে ওদের সামনে ওরকম করছেন কেন? মনোরমার রাগ হলো, সারা জীবনে যিনি একটি দিনের জন্যও খোঁজ করেন না, তাঁর হঠাৎ এমন উৎসাহ দেখলে সত্যি হাসি পায়।