ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, আমার ভাবনাও ছিল ঠিক তাই। আশ্চর্য তো!
রেখাদের বাসা আছে। তাই যাবার পথে নেমে পড়বার সময় তার টানাটানিতে ভারতী না গিয়ে থাকতে পারল না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রেখা বলল, এখন রাত আটটা বেজেছে আরও দু-ঘণ্টা দেরি করে গেলে বাসায় কিছু মনে করবে না, ভাববে ইসকুলের থিয়েটার শেষ হয়নি।
—তারপর যাবার উপায়?
–গাড়ি। আমিও যাব সঙ্গে।
তার শোবার ঘরে বসিয়ে রেখে সে বলল, বোস, একটু আসছি।
একটু পরে রেখা তার মাকে সাথে করে ফিরে এল। ভারতী উঠে দাঁড়াল। মা বললেন, চলো মা, কিছু খাবে।
-ওঃ, এই ষড়যন্ত্র করেছে রেখা! আমি খাব না।
রেখার মা হেসে বললেন, তাহলে ভুগতে হবে কিন্তু আমাকেই। ও তো কিছুতেই খাবে না। ভারতীকে খেতে হল।
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার দুজনে এসে বসল ঘরে।
–একটা রাত থেকে যা ভারতী। বাসায় খবর পাঠিয়ে দি।
-না না, আমার কাজ আছে।
ঘরে রেডিও ছিল।
-শুনবি?
ভারতী হেসে মাথা কাত করল।
কিছুক্ষণ কেটে গেছে।
-এক্কেবারে বাজে। রেখা বললো, তার চেয়ে গল্প করা ভালো।
ভারতীর কিন্তু বেশ ভালো লেগেছিল, একমনে শুনেছিল, কচিৎ শোনার দুর্বলতার মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।
রেখা বলল, খুব বেশি চালাক যারা, তাদের আমি দেখতে পারিনে। তারা মনে বাইরে এক নয়।
-মনে-বাইরে কেউ এক নয়। সে যাক, তোর কথা শুনে যাদের তুই দেখতে পারিস, সে বিষয়ে একটু আন্দাজ করতে পারছি বটে।
রেখা হেসে বলল, সত্যি, এমন সরল আমি আর কখনো দেখিনি।
–দু-একটা প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত শুনি আগে, তারপরে তো মতের মিল হবে।
–একদিন জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফিরে আসবার সময় অঞ্জন পরিষ্কার রুমাল বার করে আমার পা মুছিয়ে দিল, তারপর জুতো পরলাম।
—আরে বাপরে, এ যে দেখছি—
—চেঁচিয়ে ওঠার কোনোই কারণ নেই, তারপর যা আছে শোন। আবার এমনও হয়েছে তিন-চারদিন আমার সমুখ দিয়ে অঞ্জন ওর বুড়ো ঠাকুরদার সাথে চলে গেছে, আমাকে দেখেও দেখেনি!
–তোর তখন কী অবস্থা?
–কান্না পেয়েছে। রেখা হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে দশটা বাজল।
ভারতী বললো, আমি যাই।
—এখনই?
–বলেছি না, দরকার আছে?
তারপর নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে উঠতে ভারতী বলল, সঙ্গে এসে আর কী করবি? অনর্থক তোকে কষ্ট দেয়া।
পরের দিন স্কুলের দালানে। রানির উপযোগী যত কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার রেখা দিয়েছিল, আজ সব সে এনেছে। কাল যখন ওদের বাসায় গিয়েছিল তখনই দেয়া যেত এবং একবার বলেছিল কিন্তু রেখা মোটেই কান দেয়নি।
ভারতী বলল, এই নাও বাপু!
–এত তাড়া কীসের? রেখা যেন অবজ্ঞায় বান্ডিলটায় হাত দিল।
এ দেখে ভারতী ধরে নিল যে অনেক আছে বলেই এ ধরনের ভাবভঙ্গি। সেখানে আর কেউ ছিল না।
–গয়নাগুলো পরে ওদের তাক লাগিয়ে দিই, কি বলিস?
—আচ্ছা। কিন্তু আমি যাই, এখনই আসব আবার।
ভারতী চলে গেল। রেখা বান্ডিলটা খুলল। কিন্তু কতক্ষণ পরে এসে যা দেখল তাতে ভারতী রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। রেখা উদবিগ্ন হয়ে কী খুঁজছে।
—কী হয়েছে?
–একটা হার পাচ্ছিনে।
–একটা ছাড়া আরও ছিল নাকি!
রেখা আশ্চর্য হয়ে বললে, ছিল নাকি মানে? আমার স্পষ্ট মনে আছে।
ভারতী শুষ্ক স্বরে বলল, আমার মনে হচ্ছে—
—আরে, না না, আমি কি মিথ্যে বলছি তোর কাছে?
ভারতী কী করবে ভেবে পেল না, একটু দেখবার আশায় বাইরে গেল। একটু পরে কতকগুলো মেয়ে এসে জুটল।
—কী হয়েছে রে?
রেখা সব বললে।
একটা মেয়ে মুচকি হেসে আস্তে আস্তে বলল, আমার ঠাকুরমা একটা কথা প্রায়ই বলেন, অভাবে স্বভাব নষ্ট। যদিও সকলের বেলায় তা নয়।
রেখা বলল, অন্য কিছু হলে আমার আফসোস হতো না, কিন্তু জিনিসটা বিলেতের গোল্ড স্মিথ কোম্পানির, দাদা এনেছিলেন। তাই দুঃখ হয়। কী যে করি এখন!
-কী আর করবে? আরও ভাব করো গে!
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকতে ভারতী কিছুটা শুনে ভয়ে আর বিস্ময়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। এমন যে হবে সেটা কখনও ভাবতে পারেনি। তবু সে অনেকগুলো কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে গিয়ে বলল,
—বাসায় একবার খুঁজে দেখিস না ভাই
-এত ভুলো মন নয় আমার। আর এই তো প্রমীলাও তো দেখেছে। অন্য জিনিস হলে আমি কিছু বলতাম না, কিন্তু এ যে—আর এতই যদি টাকার দরকার ছিল, আমি কি চাইলে দিতে পারতাম না?
ভারতী একবার প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না।
কিন্তু পরের দিন এর চেয়েও বেশি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রেখা এসে হাত ধরে বলল, তোরই কথা সত্যি হল, বাসায় সেটা পেয়েছি। কিন্তু তোকে অনেক কষ্ট দেয়া হল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার মতো যেন ভারতী অনুভব করল। মুখে বলল, ব্যাপারটা খুব হাস্যকর বোধ হচ্ছে।
-হ্যাঁ, তুই আমাকে মাপ কর ভাই!
—ক্ষমা কাকে বলে তা আমাদের মতো লোকের জানবার কথা নয়, তার অর্থও ভালো করে বুঝিনে, আরও অনেক জিনিস না বোঝার মতো!
রেখা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
-কিন্তু এটা একাধিকবার প্রমাণিত হল যে, বড়োলোক এবং গরিবে এমনি খুব দরকারবোধে গম্ভীর আবহাওয়ার মধ্যে কথাবার্তা হয়তো চলতে পারে কিন্তু ভাব যাকে বলে, মানসিক ঘনিষ্ঠতা যার নাম, তা কখনও হতে পারে না।
-কেন?
—কেন, তার অনেক কারণ। প্রধান কারণ হল, একপক্ষ নিজের অবস্থা সম্বন্ধে একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সচেতন।
-কথাটা হয়তো সত্যি নয়।