হাজার হাজার লোকের এমন বিপুল সমাবেশ, মুহূর্তের পর মুহূর্ত এমন বিস্ময়কর ঘটনাবলির সঙ্গে সাক্ষাৎ, একটা গাছের নীচে দাঁড়াইয়া বিড়ি খাইতে খাইতে রহমান যতই ভাবিতে লাগিল ততই আশ্চর্য হইতে লাগিল।
ক্রমে বিকাল হইতে লাগিল। রৌদ্রে, অনাহারে, দৌড়াদৌড়িতে, চিন্তায় প্রত্যেককেই যেন এখন এক একটি ভূতের মতো দেখিতে। এমন সময় আবার মৌলবির ডাক আসিল। সে তাড়াতাড়ি আসিয়া জানাইয়া গেল যে তাহাদের এখন ঢুকিতে হইবে। আর দেরি করিলে চলিবে না, অনেক সময় পার হইয়া গিয়াছে।
সকলে দৌড়াইয়া গিয়া আর একটা গেটের কাছে গিয়া জড়ো হইল। গোলমাল আরও বাড়িয়া গেল। আকাশ বিদীর্ণ করিয়া নানারকম ধ্বনি উঠিল। কান ফাটাইয়া ফেলিবে আর কী। রহমান সকলের পিছনে ছিল, একেবারে সামনের দৃশ্য দেখিতে পায় না। পরে টের পাইল। তাহার সামনের লোকগুলি অনেকখানি অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। সে এখন একা পাশে চাহিয়া দেখিল, আরে সেই ছেলেটি, কী একটা উত্তেজনার লাল তাহার মুখ, চুলগুলি এলোমেলো, প্রাণপণে সে চীৎকার করিতেছে। রহমান বুঝিতে পারিল না সেই ভাষার অর্থ। সামনের দিকে চাহিয়া দেখিল, আশ্চর্য, এবার গেট জুড়িয়া শুইয়া কয়েকটি লোক। আর তাহাদের পা দিয়া মাড়াইয়া ভিতরে চলিয়া গেল মৌলবী,আর তাহার পেছনে আরও কয়েকজন। রহমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারল না, লোকগুলির দিকে কিছুক্ষণ। একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল সে।
এমন হল্লা সে জীবনেও শোনে নাই। কান ফাটিয়া গেলেও কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল। দেখিল, এখান হইতে সেখানে লোক ছুটাছুটি করিতেছে, কেহ ঘুসি দেখাইতেছে, কেহ দৌড়াইতেছে, হঠাৎ একটা লোক উঁচু ঢিপির উপর দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিতে শুরু করিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া দেখিল, সে লোকটি আর কেহ নয়, তাহাদের লঞ্চ পারে ভিড়িবার সময় যে লোকটি প্রথম জলের কাছে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিয়াছিল সে-ই। তাহার তখনকার কথাগুলি রহমান এখনও ভুলে নাই। তাড়াতাড়ি সে আরও কাছে গিয়া দাঁড়াইল তাহার সঙ্গে বিক্ষিপ্ত জনতা আরও ঘন হইয়া আসিল। লোকটি দৃঢ়কণ্ঠে বলিতে লাগিল :
বন্ধুগণ, আমার চাষিভাইরা…।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে। এখন প্রায় সারাটা আকাশ লাল। নীচে ধ্বংসের উৎসব দেখিয়া রক্তবর্ণ আকাশ যেন রক্তনেত্রে তাহার প্রতি চাহিয়া বিস্তর অশুভ কামনা করিতেছে। মানুষের পায়ের চাপে মাটির পৃথিবী বিদীর্ণ হইতে আর বাকি নাই। এখানকার এই কলরবের আগুনের মতো যদি কোনো শিখা থাকিত তবে সারাটা পৃথিবী নিশ্চয় পুড়াইয়া ফেলিত। বক্তা মাটিতে লাথি মারিয়া, বলিষ্ঠ ডানহাতে শূন্যে ঘুষি দেখাইয়া দৃপ্ত-স্বরে বলিল, বন্ধুগণ, আমার চাষি ভাইরা…।
কিন্তু এমন সময় হঠাৎ গুলির ভীষণ আওয়াজ, আশে পাশের সব লোক পাগলের মতো ছুটোছুটি করিতেছে, কারোর কোনো দিকে কোনো খেয়াল নাই, কে ধাক্কা খাইয়া পড়িয়া গেল, কে পায়ের তলায় পিষিয়া গেল, কারোর কোনো দিকে লক্ষ নাই, সকলেই যার যার প্রাণ হাতের মুঠায় লইয়া দৌড়াইতেছে। এক মুহূর্তে সারাটি মাঠ সশস্ত্র সৈন্যে ভরিয়া গেল।
রহমান প্রথমে লক্ষ করে নাই, যখন খেয়াল হইল তখন তাহার মাথা ঘুরিতেছে, হাত-পা কাঁপিতেছে, কানের ভিতর ভীষণ ঝাঁঝাঁ করিতে লাগিল, সে কোনো রকমে দৌড় দিল, দৌড়াইতে দৌড়াইতে শুনিতে পাইল—পেছনে কত লোকের তীব্র আর্তনাদ, কত লোকের কাতর গোঙানি। মুখ ফিরাইলে দেখিতে পাইত, কেহ রক্তাক্ত দেহে মাটিতে গড়াগড়ি দিতেছে, কেহ পড়িতে পড়িতে হাঁটিতেছে; আবার হঠাৎ বসিয়া পড়িল। শীতের দিনের গৈরিক ধুলি রক্তবর্ণ হইয়া গেল।
অনেকদূর গিয়া আর দৌড়াইতে পারিয়া রহমান তবে থামল, একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সে বসিয়া পড়িল। হাত-পা তাহার এখনও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে, বুকের ভিতর কালবৈশাখীর ঝড়। পেছনে যাদের ফেলিয়া আসিয়াছে, রহমান সেদিকে আবার চাহিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু পারিল না চক্ষু তাহার বুজিয়া আসিল। সেখানকার কথা স্মরণ করিয়া চোখে তাহার জল ভরিয়া আসিল। রহমান নির্জীবের মতো পড়িয়া রহিল।
যখন উঠিল তখন অনেক রাত। কোথাও টুঁ শব্দটি নাই। রহমান ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল, শরীরের সবগুলি গ্রন্থি তাহার বেদনায় টনটন করিতেছে। তবু কোনো রকমে সে হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক পরে নদীর পারে আসিয়া দাঁড়াইল, চমৎকার ঠাণ্ডা বাতাস বহিতেছে এখানে, নদীতে নৌকা আর জাহাজের শব্দও শোনা যায়। রহমানের মনে পড়িল সেই লোকটির কথা : বন্ধুগণ, একথা আপনারা মনে রাখবেন, আজ আমাদের যারা শুধু লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারাই আপনাকেও লাথি থেকে রেহাই দেবে না।
নদীর জলের দিকে চাহিয়া রহমানের চোখ আবার ছল ছল করিয়া উঠিল।
সত্যবতীর বিদায়
শীতের এক সুগভীর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরবেলায় অত্যন্ত ময়লা কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা পুঁটুলি হাতে করে এক বৃদ্ধা, রাজকুমার রায়ের প্রকান্ড ফটকওয়ালা বাড়ির ভিতরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমে ঢুকতে একটু দ্বিধা করেছিল। কারণ এই বাড়িতে সে এই প্রথম পদার্পণ করছে, কিন্তু মুহূর্ত পরেই সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে এক নিঃসঙ্কোচ কলেজ-বালিকার মতোই চাকর-বাকরের ছুটোছুটি আর কোলাহলে কাতর উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধার চেহারা এমন কদাকার যে হঠাৎ দেখলে ভয় হয়। উঁচু কপাল, তোবড়োনো নাক, মাংসল মুখ অথচ চোখদুটি অত্যন্ত ছোটো এবং গর্তে বসানো। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। বয়স পঞ্চাশের বেশি হলেও গায়ের চামড়া এখনও যথেষ্ট ঢিলে হয়ে আসেনি।