রমহান স্তব্ধ হইয়া গেল, তাহার মনের ভিতর সব গোলমাল হইয়া গেল, সে আর কিছুই ভাবিতে পারে না।
ম্যানেজারবাবুর মুখে সেই হাসি আর নাই। রাগে অগ্নিমূর্তি হইয়া তিনি বলিলেন, সিঁড়ি ফ্যালো, সিঁড়ি ফ্যালো।
মৌলবি হাসিমুখে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, হাসিয়া হাসিয়া সকলকে বুঝাইল, ও কিছু নয়, একটা চাকরি খালি হইলে পঞ্চাশটা লোক আসিয়া যেমন দাঁড়ায়, ইহারাও তেমনি, পঞ্চাশটা চাকরি খালি হইয়াছে তো পঞ্চাশ হাজার লোক আসিয়া হাজির হইয়াছে। জোর করিয়াই হইবে আর কী। যেন মগের মুল্লুক। যেন মামার বাড়ির আব্দার। —প্রিয়নাথ, শ্রীপতি, বাদশা মিঞা, চাঁদ-মিঞা এবং আরও অনেকে মৌলবির কথায় সায় দিল, চরের উপর বিপুল জনতার দিকে আঙুল দেখাইয়া বোকার মতো তাহারা হাসিতে লাগিল।
ওদিকে সিঁড়ি পড়িয়াছে। একজন দুইজন করিয়া সকলে নামিতেছে সকলের শেষে নামিল রহমান। নামিয়াই সে আশে পাশে চাহিয়া দেখিল, তাহাদের গ্রামের কেহ তাহার পাশে নাই, সকলে জনতার সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। সে একা একা ঘুরিতে লাগিল, একবার গেল উপরের দিকে। এখন জনতা আর সেই রকম জমাট বাঁধিয়া নাই, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে।
একজন তাহার জামা ধরিয়া টানিল-বলিল,–শুনুন?
রহমান দেখিল তাহাকে যে জামা ধরিয়া টানিতেছে সে নিতান্ত অল্প বয়সের একটি ছেলে। বয়েস ষোল সতেরোর বেশি হইবে না।
মুখের রঙ বেশ ফর্সা কিন্তু রোদে লাল ঘর্মাক্ত—মাথায় বড়ো বড়ো চুল, অবিন্যস্ত, সার্টের বুকের বোম খোলা, ফর্সা বুক আর গলা বেশ চোখে পড়ে। ছেলেটি চমৎকার মিষ্টি গলায় বলিল, আপনাদের বাড়ি কোথায় ভাই?
রহমান বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। ছেলেটি আবার বলিল, বলুন না, আপনার বাড়ি কোথায়? রহমান এবার বলিল, বনগাঁ।
—বনগাঁ। বাঃ চমৎকার নামটি তো। আচ্ছা, সেটা এখান থেকে কতদূর হবে? রহমান হিসাব করিয়া বলিল কতদূর হইবে।
ছেলেটি বলিল, এখানে এই এলেন, না? এখানে কেন এসেছেন? এমনি, বেড়াতে না?
তাহার এই অনুসন্ধিৎসায় রহমান প্রথমে একটু বিরক্তি বোধ করিল, কিন্তু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আর মিষ্টি কথা শুনিয়া তাহা ভুলিয়া গেল। বলিল, এহান কাজ করতে আইছি।
–ও। ছেলেটি চারিদিকে চাহিয়া একটু পরে বলিল,-কিন্তু কাজ যারা এখন করছে তাদের উপায় হবে কী। ব্যাপার কী হয়েছে জানেন? এদের কোনো দোষ নেই তবু এদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাদের সে জায়গায় বসানো হবে। যার আর কোনো উপায় নেই এমন একজনের ভাত মারতে আপনার ইচ্ছে হয়।
রহমান কিছু বলিল না।
-বলুন না ইচ্ছে হয় কি না?
রহমান তবু কিছু বলিল না। ছেলেটি বলিল, মনে করবেন না, আপনিও চিরকালই ওদের সুনজরে থাকতে পারবেন, আপনাকেও এমনি একদিন তাড়িয়ে দেবে।–এই বলিয়া একটু হাসিয়া ছেলেটি চলিয়া গেল।
রহমানের ইচ্ছা হইল তাহাকে একটি বিড়ি খাওয়াইয়া দেয়, কিন্তু ছেলেটি তখন চলিয়া গিয়াছে।
রৌদ্রের তেজ ক্রমেই বাড়িতেছে। বালুর চর চিক চিক করে। নদীর হাওয়া রৌদ্রের মতোই তীব্র।
রহমান এদিক সেদিক ঘুরিয়া একবার উপরের দিকে গেল, দেখিল গেটের কাছে কয়েকটি লোক হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে অর্থাৎ কাহাকেও যাইতে দিবে না, এই মতলব। একটু দূরে তাহাদের গ্রামের কয়েকজন হাত গুটাইয়া জটলা করিতেছে। রহমান তাহাদের সঙ্গে জুটিল। সেই জটলায় বাদশা মিঞাই প্রধান বক্তা। তাহাকে দেখিয়া সে এক পলক হাসিয়া বলিল, রহমানরে হ্যারা তো যাইতেই দিব না, মনডা কয়।।
রহমান হাসিল, একটু পরে কী মনে করিয়া হঠাৎ বলিল, আইচ্ছা, বাদশা মিঞা—
-কও?
—হ্যাঁরা জোর কইরা গেলে কী করতো?
বাদশা মিঞা সমস্যায় পড়িল। সে এমন ব্যাপারের কথা আরও শুনিয়াছে বটে কিন্তু ইহার পরের ঘটনা আর জানে না। আমতা আমতা করিয়া বলিল, কী করতো আবার। ধইরা, মাইর দিত!
বাদশা মিঞা অকূলে কূল পাইয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, হ, মাইর দিত। ঠিক, ঠিক, ঠিক।
সুতরাং স্থির হইল, ওখানে জোর করিয়া ঢুকিলে উহারা খুব কষিয়া মার দিবে।
কিছু পরে মৌলবি আসিয়া বলিল, সামনের আর একটা গেটে তাহাদের যাইতে হইবে। সেখানে সকলেই আছে, শুধু তাহারাই কেন এখানে দাঁড়াইয়া আছে?
সকলে তাড়াতাড়ি মৌলবিকে অনুসরণ করিল।
সেই গেটের কাছে গিয়া দেখিল সেখানেও কয়েকটি লোক তেমনি হাত ধরাধরি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
বাদশা মিঞার মেজাজটা খারাপ হইয়া গেল।
—যেখানেই যাই সেখানেই ইহারা জোঁকের মতো লাগিয়া থাকে কেন? মৌলবি তুড়ি মারিয়া বলিল, ভাই তোমরা হগলে আস।
এই বিপদের সময় ভাগ্যিস মৌলবির মতো মানুষ সঙ্গে ছিল। তা না হইলে কী উপায় হইত কে জানে। সকলে দল বাঁধিয়া সামনের দিকে গেল কিন্তু ততোক্ষণে সেই লোকগুলি সারা গেট জুড়িয়া শুইয়া পড়িয়াছে।
এ আবার কোন কায়দা? বাদশা মিঞা আশ্চর্য হইল। মার দিবে না তো! ব্যাপার দেখিয়া রহমান দূরে সরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে আরও কয়েকজন। আসিল। মৌলবি আর শেষ পর্যন্ত যাইতে পারিল না।
এইভাবে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। সূর্য এখন মাথার উপর উঠিয়াছে। চারিদিকে তেমনি গোলমাল। এই সমস্যার কখন যে শেষ হইবে, রহমান ভাবিয়া কুল পায় না।
এদিক-ওদিক দৌড়াইয়া, এ গেট—ও গেট করিয়া তাহার ক্ষুধা পাইয়া গিয়াছিল। একটা ছোটো পুটলিতে বউ কিছু মুড়ি চিড়া আর গুড় বাঁধিয়া দিয়াছিল। রহমান আর একজনকে লইয়া একটু নির্জনে গিয়া পুটলি খুলিয়া বসিল। খাওয়া শেষ হইলে নদীতে গিয়া হাত ধুইয়া আসিল। এখন একটা বিড়ি না খাইলে চলে না। কিছু দূরে একটা দোকানে গিয়া এক পয়সার বিড়ি সে কিনিল। কিন্তু একটা মুখে দিতেই আর একজন সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। এক মুহূর্তে এক পয়সার বিড়ি শেষ হইয়া গেল। রহমান নূতন বিবাহ করিয়াছে, সে এমনি দিয়া থুইয়া খাইবে না তো কে খাইবে!