–রহমান? ও রহমান?
রহমান ধড়মড় করিয়া জাগিয়া উঠিল, ভালো করিয়া চাহিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, কে? আজু?
মৌলবি তাহার বউয়ের নাম জানিত হাসিয়া বলিল, না আমি তোমার বউ না, আমি মৌলবি।
রহমান চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে বলিল, ও!
কিন্তু মৌলবি কাজের লোক, তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখিয়া বলিল,
–ভোর অইয়া আইছে, আর কত ঘুমাইবা?
রহমান বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল, সেখানে অনেক অন্ধকারের সারি এখনও ঠেলাঠেলি করিয়া মরিতেছে।
ম্যানেজারবাবুর কামরায় আলো দেখা যায়।
মৌলবি গল্প করিতে লাগিল, তাহার অভিজ্ঞতার ইতিহাস বলিয়া যাইতে লাগিল, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, রহমান কেবল হাঁ করিয়া শুনিল।
মৌলবি অনেক গল্প করিল।
কিন্তু ভোর আর হয় না, তাহারা উঠিয়া এবার ওধার অনেক ঘুরিল। দুই একজনকে জাগাইয়া গল্প করিল ঘণ্টা দুই চলিয়া গেল। তবু ভোর আর হয় না, বাহিরে তেমনি অন্ধকার, গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা কেবল জলের শব্দ।
মৌলবির ঘড়ির কাঁটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন গিয়া থামে, সে তথা রহমান আজও জানিতে পারিল না, কেবল হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল।
আবার সে একা একা কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল, লঞ্চের এটা-ওটা উঁকি ঝুঁকি মারিয়া কতক্ষণ দেখিল, শেষে হাত পা গুটাইয়া বউ-র কথা ভাবিতে লাগিল।
অনেকক্ষণ পরে ভোর হইল। এখন মস্তবড়ো নদী, ওপারের সীমানা কুয়াশায় ভরা, সূর্যের আলোয় জলের উপর কেহ কতকগুলি চকচকে নতুন টাকা ছড়াইয়া রাখিয়াছে মনে হয়। নদীর দুইপাশে মাঝে-মাঝে ইটের খোলা, পাটের গুদাম।
দূরে মিলের চিমনি দেখা গেল। কিন্তু ধোঁয়ার চিহ্ন নাই। কোথা হইতে আসিয়া আবার মৌলবি দেখা দিল। কোনো নতুন খবর সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে নিশ্চয়। বলিল, আমরা আইসা পড়ছি।
৪.
সকলের মধ্যে একটা সাড়া পড়িয়া গেল। তাহারা তাহাদের কর্মস্থলে আসিয়া পড়িয়াছে। সকলে সামনের দিকে ছুটিয়া আসিল। ওই যে কী একটা গম্বুজের মতে, এটাই কী তাদের মিল? মৌলবি তাদের বুঝাইয়া দিতে লাগিল। সে সবই জানে। সকলে বিস্ময়ে আর আনন্দে এমন একটা জিনিসের প্রতি চাহিয়া রহিল।
পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। ধীরে ধীরে লঞ্চের গতি মন্থর হইয়া আসিল, এখন পাড়ে ভিড়িবে। ম্যানেজারবাবু আসিয়া দেখা দিলেন। কেমন একটা সফলতার আনন্দে তাঁহার সারামুখ উজ্জ্বল। সকলে তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। দুই হাত ছাড়িলে যদি চলে সেখানে পাঁচ হাত সরিয়া দাঁড়াইল।
কিন্তু তখনও লঞ্চটা পারে একেবারে ভিড়ে নাই, ধীরে ধীরে যেন একটা ভীষণ কলরব, সহস্র কণ্ঠের মিলিত চীৎকার ধ্বনি সকলের কানে আসিয়া বাজিল। সকলে উৎকর্ষ হইয়া উঠিল, মিল দেখার আনন্দে একেবারে ভাঙিয়া না পড়িয়া রহমান আগেই কিছুটা লক্ষ করিয়াছিল, এখন সকলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হইয়া শব্দটা আরও লক্ষ করিতে চেষ্টা করিল। মৌলবির মুখে বিস্ময়ের চিহ্নমাত্র নাই, সে নিতান্তই নির্বিকারভাবে ম্যানেজারবাবুর পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, ব্যাপারটা সকলের আগে বুঝিবার আশায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। কিন্তু ম্যানেজারবাবুর মুখ হঠাৎ ম্লান হইয়া গিয়াছে, মুখের সেই মৃদুমন্দ হাসি আর নাই। লঞ্চ চালকদের কী একটা নির্দেশ দিতে তিনি তাড়াতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেলেন।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার সন্দেহ নাই। নদীর পারেই প্রকান্ড চর, ধু-ধু করে বালু। তার পরে মিলের সীমানা। সেই ভীষণ গোলমাল আরও ভীষণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকান্ড চরটা মুহূর্তে হাজার হাজার লোকে ভরিয়া গেল; সেই লোক-গুলি প্রাণপণে দৌড়িয়া আসিতেছে, প্রাণ যায় কী বাঁচে। ব্যাপার দেখিয়া রহমানের চোখে বিস্ময়ের অন্ত নাই—যেন একটা প্রকান্ড নদীর মুখ হঠাৎ খুলিয়া গিয়াছে, তাহার সমস্ত জল বিপুল বেগে সারাটা পৃথিবী ভাসাইয়া লইল। রহমানের বুক কাঁপিতে লাগিল, নিঃশ্বাস দ্রুত হইয়া আসিয়াছে।
লোকগুলির কতক হুড়মুড় করিয়া জলে নামিয়া পড়িল, লঞ্চটাকে একেবারে ঘিরিয়া ফেলিল। আর বেশিরভাগই দাঁড়াইয়া রহিল পাড়ে কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা ভয়ানক চঞ্চলতা,কেহ হাত নাড়িয়া কিছু বলিতেছে, কেহ কেবলই চীৎকার করিতেছে, সকলের মুখে চোখে কার্যকলাপে এমন একটা ভাব যেন এখনই পারিলে লঞ্চটাকে ডুবাইয়া দেয়। আর কী গোলমাল! আকাশকেও ফাটাইয়া চৌচির করিয়া দিবে মনে হয়। অমন দৃপ্ত রাগান্বিত পদক্ষেপে তাহাদের পায়ের নীচের ভূমিখন্ড মুহূর্তে ধসিয়া বাইবে যেন, তাহাদের চীৎকার ধ্বনিতে নদীর জলও উত্তাল হইয়া উঠিল।
কিন্তু রহমান লক্ষ করিয়া দেখিল, একেবারে সামনে একটা লোকের মধ্যে পেছনের সকলের শক্তি যেন একত্রিত হইয়াছে। লোকটার বয়স অল্প, চেহারায় এই হাজার হাজার লোকের মধ্যে একটা পার্থক্য ধরা পড়ে। সে হাত নাড়িয়া ভয়ানক চীৎকার করিয়া কী যেন বলিতেছিল, প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই শোনা যায় নাই, কিন্তু শেষে গোলমাল আপনিই কমিয়া আসিল। রহমান আশ্চর্য হইয়া শুনিল, লোকটা দৃপ্তস্বরে বলিতেছেঃ বন্ধুগণ, আমাদের দেখে আশ্চর্য হবেন না। আমরা এই মিলেরই শ্রমিক, আপনারা যেখানে কাজ করতে এসেছেন আমরা সেখানেই প্রথম কাজ করতে আসি। আমরা জানি আপনাদের শুধু চাকরির কথা বলেই আনা হয়েছে, আসল কথা বলা হয়নি। এই চাকরির ভেতর কী রহস্য তা আপনাদের কাছে গোপন করা হয়েছে। বন্ধুগণ, আমাদের কথা আপনারা একটিবার শুনুন, আমাদের বিশ্বাস করুন। যারা আপনাদের চাকরি দেবে বলে নিয়ে এসেছে তাদের আপনারা চেনেন না, কিন্তু আমরা চিনি। আমরা তাদের কাছে শুধু আমাদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতে গিয়েছিলাম, আমাদের সামান্য কয়েকটা মাত্র দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম কিন্তু তারা গ্রাহ্যই করেনি। তারা আমাদের মুখের ওপর লাথি মেরেছে! কিন্তু আমরা কেন তা সহ্য করব? আমরা স্ট্রাইক করেছি, মিলের কাজ বন্ধ। আমরা তার প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের এই শক্তিকে পিযে ফেলবার জন্যে, আমাদের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়ার জন্যে তারা মিথ্যে কথা বলে আপনাদের এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আপনারা তাদের বিশ্বাস করবেন না। ভাই সব। আপনাদের চোখে পৃথিবী যেমন, আমাদের কাছেও তাই, আপনাদের যতখানি শোষণ দুঃখ দুর্দশার কষ্ট সহ্য করে চলতে হয়, আমাদেরও তাই। আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই। আজ এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কাল কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই—আমার চাষি ভাইরা, দোহাই আপনাদের, ভাই হয়ে ভাই-এর মুখের ভাত এমন করে কেড়ে নেবেন না। একথা মনে রাখবেন, আজ যারা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারা আপনাদেরও সেই লাথি থেকে রেহাই দেবে না। বন্ধুগণ আমরা আপনাদের ভাই, ভাই-এর কথা একটিবার মন দিয়ে শুনুন, ভাই-এর কথা বিশ্বাস করুন—আপনারা এ কাজে যোগ দেবেন না, দোহাই আপনাদের, যে লোক আজ আপনাদের ভাই-এর ভাত কেড়ে নিচ্ছে, তার উল্লাসকে আর বাড়াবেন না।