রহমান পিতৃআজ্ঞা যথারীতি পালন করিল।
তাড়াতাড়ি খাইয়া দাইয়া শুইতে আর দেরি করিল না।
কিন্তু রাত বারোটা বাজিতে আর কতোক্ষণ লাগে? বুড়া রহমানের ঘরের দরজার কাছে গিয়া ডাকিল, বাপ, সময় অইয়া গেছে, অ্যালা ওঠ।
কোনো উত্তর আসিল না, বা কেউ বাহির হইয়া আসিল না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অপেক্ষা করিয়া বুড়া মনে মনে হাসিল, নিজের মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়িল।
অথচ এদিকে বারোটা বাজিয়া যাইতেছে। বুড়া আবার ডাকিল, রহমান ওঠ ইষ্টিমার ছাইড়া দিতে আর কতোক্ষণ! এই বলিয়া নিজের ঘরের দাওয়ায় আসিয়া আবার তামাক সাজিতে বসিল। কিছুক্ষুণ এমনি কাটিবার পরও রহমানকে আসিতে না দেখিয়া হুঁকা হাতে বুড়া আবার বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখিল, দাওয়ার খুঁটি চাপিয়া ধরিয়া অন্ধকারে নিঃশব্দে রহমান বসিয়া আছে।
হুঁকাটি তাহার হাতে দিয়া বুড়া বলিল, তাড়াতাড়ি তৈয়ার অইয়া লও, বাপ, আর দেরি কইরো না।
রহমান তেমনি খুঁটি ধরিয়া বসিয়া রহিল।
এক হাতে একটি বহু পুরোনো লণ্ঠন, আর এক হাতে একটি প্রকান্ড চকচকে লাঠি লইয়া পথ দেখাইয়া চলিল বুড়া। রাস্তায় সাপ বা মানুষের ভয় থাক বা নাই থাক, এ দুটিকে ছাড়া সে কখনো পথ চলিতে পারে না। ধীরে ধীরে চলিতে চলিতে সে বলিল, হেইখান গিয়া চিঠি দিও, তা না অইলে চিন্তায় থাকুম।
রহমান আস্তে বলিল, আইচ্ছা। গোলাম আলীর বাড়ি পার হইলেই একটা মস্ত বকুল গাছের নীচ দিয়া হাঁটিতে হয়। সেখানে বকুল ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া থাকে। সেই গাছের নীচ দিয়া চলিতে চলিতে রহমানের শরীর অবশ হইয়া আসিল, ঘুমে ভরা চোখ বুজিয়া আসিল, সে অনুভব করিল এখনও যেন সে কারও ফুলের মতো বুকে মুখ রাখিয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলিতেছে।
ঠক ঠক করিয়া এখানে লাঠি ফেলিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বুড়া আবার ডাকিল, বাপ।
—কও? কিন্তু কিছুক্ষণ কান পাতিয়া থাকিয়াও রহমান আর কোনো কথাই শুনিতে পাইল না। বোধ হয় যা বলিতে হইবে সব ভুলিয়া গিয়াছে বুড়া।
একুট পরেই লঞ্চের আলো দেখা গেল। আশে পাশে অনেক লোক ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সকলেই উচ্চস্বরে গল্প করিতেছে। কেহ সিঁড়ি বাহিয়া লঞ্চে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে। সব মিলিয়া একটা মস্ত হল্লা।
একটু নির্জনতায় ছেলেকে টানিয়া বুড়া আবার বলিল, বাপ?
-কও?
একটা কথা কমু। এত বুড়া হইয়া গেলাম, তুমি আমারে ছাইড়া কোনো কালে কোনো খানে যাও নাই, কিন্তু আইজ ছাইড়া গেলা, আমার মনটারে কী দিয়া বান্ধুম, তুমিই কও? বুড়া অনেক কষ্টে তাহার সবগুলি কথা এতক্ষণে বলিয়া ফেলিল এবং ঝর ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। এমন দৃশ্যের সঙ্গে রহমানের এই প্রথম পরিচয়, সে কী যে করিবে ভাবিয়া পাইল না।
নদীর উপরের ঠাণ্ডা বাতাসে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো কাঁপিতেছে। চারিদিকে জলের গন্ধ। আকাশে অজস্র তারা। পাশেই আগামী কোনো সুখের সৌরভে বিহ্বল লোকজনের হল্লা। বুড়ার শীর্ণ হাতের লাঠিখানাও ঠকঠক করিয়া কাঁপিতেছে।
অনেকক্ষণ পরে রহমান উপরে উঠিয়া দেখিল, সেই বাচ্চা মৌলবি সারা লঞ্চময় চরকিবাজীর মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। লোকটা এমনি পাতলা ছোটোখাটো মানুষ যেন হাওয়ার সঙ্গে উড়িয়া চলে, এক মিনিটে হাজার মাইল অতিক্রম করে।
রহমানকে দেখিয়া সে ঘড়ি দেখিয়া এদিক সেদিক তাহার চঞ্চল দৃষ্টি বুলাইয়া তর তর করিয়া বলিল, এতক্ষণে আইছ! টাইম আইয়া গেছে।
মৌলবি টাইম ধরিয়া চলে। আবার ঘড়ি দেখিয়া সে সামনের দিকে অগ্রসর হইল।
রেলিং ধরিয়া রহমান একা দাঁড়াইয়া রহিল।
কয়েক হাত নীচেই তাহাদের গ্রামের নদী, আজ ছাড়িয়া যাইতেছে বলিয়া অত্যন্ত আপনার বলিয়া মনে হয়। নদীর জলে লঞ্চের আলো পড়িয়া চিকমিক করিতেছে, লঞ্চের ভিতরের মানুষগুলির আবক্ষ ছায়াও সেখানে দেখা যায়, অন্ধকারের বুকে কেবল আরও কতকগুলি গভীর অন্ধকারের মতো মনে হয়। আর তাহাদের আত্মীয়-স্বজনরা—তাহারাও লণ্ঠন হাতে বিদায়ের প্রার্থনায় কাতর।
রহমানের চোখের পাতা বুজিয়া আসিল, সে দেখিল, নদীর জলে কে এক নারীমূর্তি, নাকের চোখের জলে এক হইয়া তাহাকে ডাকিতেছে। তাহার নাকের ডগায় ঘাম, ঘর্মাক্ত সমস্ত শরীরটিকে রহমান ঝুঁকিয়া দেখিল। তাহার গায়ে এখনও সেই মেয়েটির ঘামের গন্ধ। আরও নিবিড় হইয়া সে সেই গন্ধ শুকিতে লাগিল।
ঘুমে তাহার চোখ জড়াইয়া আসিল।
কোনোরকমে একটা জায়গা করিয়া ছটো পুটুলিখানা মাথার নীচে রাখিয়া সে শুইয়া পড়িল। একটু পরেই সে স্বপ্ন দেখিল। আকাশে ঝড়ের পূর্বাভাষ, এখন ভয়ানক বাতাস ছাড়িয়াছে দীর্ঘ সুপারি আর নারিকেল গাছের মাথায় ভীষণ মাতামাতিতে নদীর জলে দুরন্ত ঢেউ, বড়ো বড়ো ধান গাছের শিষগুলি যন্ত্রণায় কাঁপিতেছে, আকাশে পাখির কলরব, রহমান যেন শুনিতে পাইল, তাহাদের গোয়াল ঘরের গোরুগুলি মা মা করিয়া কাতরস্বরে ডাকিতেছে। মনে হয় এমন করিয়া যেন তাহারা আর কোনোদিনও ডাকে নাই। তাড়াতাড়ি দৌড়াইয়া গিয়া সে দেখিল, তাহার গোরু নয় তো, তাহার বউ, আর গোয়াল ঘরটা আসলে গোয়াল ঘর নয় তো, তাহার শোবার ঘর। বউ তাহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, গলা জড়াইয়া ধরিল, বুকের মাঝখানে তাহার হাতকে রাখিয়া বলিল, এই দ্যাখো, এহান কেমুন ব্যথা। তোমারে ছাইড়া আমি থাকতে পারুম না বন্ধু মইরা যামু। একটু পরে রহমান টের পাইল, তাহার দুইটি পা আরও দুইটি পায়ের সঙ্গে সুতার মতো হইয়া গিয়াছে।