শীতের সকাল। রহমানের বাড়ি পার হইয়া দূরে কাহাকে যেন দেখিয়া বলরাম পাশে সরিয়া দাঁড়াইল, লোকটা একটু কাছে আসিলে পর হাসিয়া বলিল, কাকা না গো? ইয়াসিন বলিল, হুঁ।
-কী যে অইছে, দূরের থনে তোমারে চিনতেই পারি নাই। হ্যাশে— হুনছোনি? তোমরা যতই কও, আমার কিন্তু মনডা খালি কয় এখবর মিছা।
–দুরো! তোমার তো হগলটাতেই খালি সন্দ। ইয়াসিন পরম নিঃসন্দেহে অন্যদিকে চাহিয়া রহিল—এমনভাবে চাহিল যেন ইহার পরে আর দ্বিতীয় কথা নাই। সে সকলের আগে নিজের কানে যাহা শোনে, তাহাকে মিথ্যা বলিয়া প্রমাণ করিবে, এমন হতভাগ্য এ অঞ্চলে কেহ নাই। ধীরে ধীরে সে বলিল, বাবুটি যেকোনো মিলেরই বড়বাবু, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই এবং তিনি যে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছেন, একথাও মিথ্যা নহে-বলরাম তাহার কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে। তাহার ছোটো বেলায়ও যে এমনি আর একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে তখন ছোটো, হঠাৎ এমনি একদিন কোথা হইতে এক বাবু আসিয়া সারাটা গাঁ তোলপাড় করিয়া তুলিল!–
ইতিমধ্যে আকবার আলি আসিয়া তাহার কথা মনোযোগ দিয়া শুনিতে ছিল। তাহার হাতে একটি আমের কচি ডাল, সেটা দাঁত দিয়া চিবাইতে চিবাইতে সে মাথা নাড়িতে লাগিল। ফিক করিয়া কিছু থুথু ফেলিয়া বলিল, লড়াইয়ের খবর রাখনি, ইয়াসিন মিঞা? হেইর লেইগা ফাঁকি দিয়া লোক লিবার আইছে, জান?
আরও দুই একজন আসিয়া জুটিয়াছিল। এমন একটি কথা শুনিয়া তাহারা সকলে বিস্ময়ে আর ভয়ে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু সকলে আকবরের দিকে আকৃষ্ট হইতেছে দেখিয়া ইয়াসিন রাগিয়া উঠিল, হঠাৎ নিজের বুড়া আঙুলটি তাহার চোখের সামনে ধরিয়া বলিল, তুমি এইটা জান? আকবর আলী গম্ভীর ভাবে বলিল, তোমার কুন ডর নাই, হ্যারা বুড়া মানুষ গো নিব না।
ঝগড়া ক্রমেই বাড়িয়া চলিল। আরও বাড়িত। কিন্তু কে একজন বলিল, বাচ্চা মৌলবি।
সকলের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হইল, ঝগড়া কিছুক্ষণের জন্য থামিল—এই আশায় যে বাচ্চা মৌলবিই ইহার মীমাংসা করিতে পারিবে।
বাচ্চা মৌলবি বলিয়া তাহাকে সবাই ডাকে, তার একমাত্র কারণ এই যে তাহার বয়স অত্যন্ত অল্প এবং এই বয়সেই সে মৌলবি হইয়াছে। সে পাশের গ্রামেই থাকে এবং মাঝে মাঝে কোনো পত্রিকা হাতে করিয়া আসিয়া বেলা দুইটা আড়াইটা অবধি এ অঞ্চলের সকলকে যুদ্ধের খবর শুনাইয়া যায়। শহরের খবর তাহার কাছে অবিদিত নাই, মাসের মধ্যে পনেরো দিনই তো সে সেখানে কাটায়। এ কথা সবাই জানে, নবাবের সঙ্গে বসিয়া সে খানা খাইয়াছে এবং নবাব সাহেব তাহার হাতে চুমা খাইয়াছেন।
বাচ্চা মৌলবির পরণে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি, গোঁফ এখনও ভালো করিয়া উঠে নাই, হাতে একটা ঘড়ি। কিন্তু ঘড়িটা কখন চলিতে শুরু করে, আর কখন থামে এ খবর কেউ রাখে না। ঘড়িটা একবার চোখের সামনে ধরিয়া এই শীতের সকালেও পত্রিকা দিয়া বাতাস খাইতে খাইতে মৌলবি শুদ্ধ ভাষায় বলিল, ওনারে আমি চিনি। এই বলিয়া ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে তাহার এক সুদীর্ঘ পরিচয়ের ইতিহাস বিবৃত করিয়া অবশেষে বলিল, তাইন লোক নিতে আইছে ঠিকই। রহমান তোমার ঘরে তা তো তাঁত আছে তোমারে নিবে আগে।
রহমান এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিল, মৌলবির কথা শুনিয় হাসিয়া ফেলিল। নতুন বিবাহ করিয়াছে সে, তেলে আর জলে চুলগুলি চমৎকার পরিপাটি চোখে সুরমা, পরনের জামা আর লুঙ্গি রঙিন।
বেলা হইয়া যাইতেছিল। মৌলবির সময় নাই, একবার সূর্যের দিকে এবং আর একবার ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, দশটা বাইজা গেছে, আমি যাই, কাজ আছে, আমার একটু চৌধুরী বাড়ি যাইতে অইব।
আকবর আলী তবু কিছুতেই বিশ্বাস করিবে না। কিন্তু মৌলবিকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি তাহার পাশে গিয়া ফিক করিয়া থুথু ফেলিয়া বলিল, মৌলবি।
মৌলবি পাশে তাকাইল।
আকবর আলী বলিল, আমার একটা কথা রাখবা তুমি? কও?
—আমার ভাই-এর লেইগা একটু কইয়া দিবা তুমি–
মৌলবি পরিষ্কার ভাষায় বলিল, দিব, দিব। বলিয়া তর তর করিয়া চলিয়া গেল।
শত আনন্দ হইলেও হাসিয়া কখনো আনন্দ প্রকাশ করে না ইয়াসিন। সকলের দিকে একবার তাকাইয়া সে বলিল, অহনও বিশ্বাস অয় না?
বলরাম আগে সন্দেহ প্রকাশ করিলেও ইতিমধ্যে আবার বিশ্বাস করিয়া ফেলিয়াছে। ইয়াসিনের কাছে ঘেঁসিয়া বলিল, কাকাগো, তোমার কাছেই আইছিলাম, একটা আলাপ করুম। মন্ডল-পুত্র কীসের পরামর্শ চাহিতে আসিয়াছে কে জানে। ইয়াসিন হাসিল।
৩.
বিকালের রৌদ্রে চারদিক ঝলমল করিতেছে। গাছের ছায়ার নীচে একটা চেয়ারে বসিয়া ম্যানেজারবাবু মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ তোমাদের গাঁ-টি বেশ ভালো লেগেছে। তোমরাই দেশের গৌরব। ফেমিন হবার আগে সারা ভারতের কাপড় জোগাতে তোমরাই। এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে দিতে, অথচ আজ শুকিয়ে মরছো। তোমাদের কদর কজনা বোঝে? নদীর দিকে আঙুল দেখাইয়া তিনি বলিলেন, সেখানেও এমনি নদীর হাওয়া, নদীর একেবারে পার ঘেঁষেই চমৎকার ব্যারাক সেখানে, তোমরা থাকবে। হাতের কাছ হাসপাতাল, খেলার মাঠ, সিনেমা , যখন যা খুশি!–ম্যানেজারবাবু মৃদু হাসিলেন।
রহমান নাম লিখাইয়া ফেলিল। আজ রাত বারোটার সময় লঞ্চে উঠিতে হইবে।
বাড়ি ফিরিলে তাহার বুড়া বাপ কাটি ছেলের হাতে দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খাওন দাওন সাইরা শুইয়া পড়, বারোটা বাজলে পর আমি ডাইকা দিমুনে, যাও শুইয়া পড় গিয়া।