বাসন্তী কিছুই বুঝিল না। শুধু তপনের ঘাড় ধরিয়া মুখের কাছে মুখ নিয়া উৎসুক নেত্রে এই অভিনব জিনিসটি দেখিতে লাগিল। কিছু পরে তপন বলিল, পেছনে যাও তো এখন তোমার ফটো তুলব। ওই গাছটার তলে যাও।
বাসন্তী পিছু হাটিয়াই যাইতে লাগিল। তপন ক্যামেরাটার দিকে চোখ রাখিয়া মনোযোগের সহিত উহা ঠিকমত ধরিতেছিল। হঠাৎ একটা কাজে চকিত হইয়া সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, বাসন্তী নাই। শব্দের মধ্যে একটা চীৎকারের রেশ ছিল। তপন উদভ্রান্তের মতো গাছটার কাছে আসিয়া দেখিল, গাছটার ঠিক পরেই একটা গভীর খাদ। কিছু দেখা যায় না। সে ক্যামেরাটা দূরে ফেলিয়া পাগলের মতো ডাকিল, বাসন্তী, বাসন্তী? আমি যে তোমার জন্যে বসে আছি, ফটো তুলবে না! শিগগির এসো, লক্ষ্মীটি, আমি তোমার সঙ্গে আর কখনও ঝগড়া করব না। এসো বাসন্তী, বা-স-ন-তী–
কেহই উত্তর দিল না। কতকগুলি প্রতিধ্বনি তাহাকে ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল।
তপনের মুখ বিবর্ণ। সে কাঁদিয়া উঠিল, মাটি আঁচড়াইতে লাগিল।
অচলায়তন ও নির্জনতার মাঝে একটা প্রাণের বিসর্জন, কতটুকু তাহার মূল্য জানি না। জানি পৃথিবী টলিবে না এই ঘটনায়। পৃথিবীর বুকে ইহা নূতন নয়, জানি মানবজীবন কেমন দ্রুতগতিতে চলিয়াছে, তেমনই চলিবে, কিন্তু অকালে যে ফুলটি ঝরিয়া পড়িল তাহারই কাহিনি লিখিতে কেন আমার এত আগ্রহ! চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হইয়াই আসে যদি, তবু কলম কেন থামে না! কেমনে বলিব, ইহা যে আজও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।
উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রলয় নৃত্য আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। নীচে মাটির বুকে বিয়োগ-বিধুর এক শিশুচিত্তের বেদনা, মনে করিতে কষ্ট হয়।
সংকেত
তখনও আকাশ ভালো করিয়া পরিষ্কার হয় নাই, নানারকমের পাখি আগামী দিনের ঘোষণায় প্রাণপণে ডাকাডাকি করিতেছে, বনগ্রামের মরা নদীর কঠিন বুকেও ভয়ানক ঝড় তুলিয়া কাহাদের এক লঞ্চ তীরে আসিয়া ভিড়িল।
প্রথমে দেখিয়াছিল অন্ধ দশরথ। তাহার দুই ছেলে—এক ছেলে গিয়াছে বাহিরে আর এক ছেলে যার বয়স অল্প, হাতের বৈঠাটি এক পাশে রাখিয়া সে তখন অন্ধ পিতার জন্য এক ছিলিম তামাক ভরিতেছিল, আর দশরথও তখন তাহার হাতের জালটি গুটাইয়া গলাটি একটু ভিজাইবার আশায় পশ্চিমের প্রায়ান্ধকার আকাশের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চাহিয়া ছেলের তামাকের প্রতীক্ষা করিতেছিল, হঠাৎ কেমন একটা গুম গুম আওয়াজ তাহার কানে বাজিতে লাগিল, কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগে কান পাতিয়া শুনিয়া সে ডাকিল, রাম?
দশরথ-পুত্র রাম তখন তামাক ভরিতে ব্যস্ত, তাহার কিছুই ভালো লাগিতেছে , রাগিয়া বলিল, ক্যান?
দশরথ বলিল, কিছু হুনসনি?
রাম মুখ না তুলিয়াই বলিল, না।
দশরথ আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, দ্যাখ তো চাহিয়া ইস্টীমার তো না?
—তা অইলে তুমি কিছু দেখতে পাও, না বাবা?
রামচন্দ্রের বিশ্বাস, তাহার বাবা তেমন করিয়া না দেখিলেও কিছুটা নিশ্চয় দেখিতে পায়, কিন্তু দশরথ ইহা শুনিলে আর রাগ সামলাইতে পারে না। এবার হয়তো শুনিতে পায় নাই, তাই রক্ষা। কোনো উত্তর না পাইয়া আবার সে ডাকিল, রাম।
-কী। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাম একবার সেদিকে তাকাইল : দশরথের কথা মিথ্যা নয়, সত্যই একটা ছোটো জাহাজের মতো চোখে পড়ে, এখন আওয়াজ আরও স্পষ্ট–
দারুণ খুশি হইয়া সে বলিল, হ, বাবা।
—দ্যাখ আমার কথা হাছা কি না। দশরথ হাসিয়া ফেলিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিল : সে অনেকদিন আগেকার কথা, বেলতলীর জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে সদ্য বিলাত হইতে ফিরিয়া সেই প্রথম যখন নিজ গ্রামে প্রবেশ করিলেন, তখন আসিবার পথে বিস্তর দুর্ভোগ ভুগিয়া এত বিরক্ত হইয়াছিলেন যে তার কিছুদিন পরেই দেখা গেল, মস্ত এক স্টিমার ভীষণ হাঁকডাকের সঙ্গে আশপাশের গ্রামের সমস্ত লোককে আনিয়া হাজির করিয়াছে নদীর পারে। স্টিমার কোম্পানি নতুন লাইন খুলিয়াছে, তখনকার নদী কী আর এখন আছে। দশরথ সেই দৃশ্য দেখিয়াছে তাহার জীবনে। আজকাল কী আর সেরকম ঘটনা ঘটে। সেসব দিনের মানুষও আজ আর নাই, তাহাদের কীর্তিও নাই। এবং পরক্ষণেই এই অদ্ভুত খবরটি শ্রীরামচন্দ্রের মুখে সারা গ্রামে রটিয়া গেল।
অনেকক্ষণ পরে লঞ্চের সিঁড়ি বাহিয়া যে লোকটি সদলবলে নামিয়া আসিল, তাহার গায়ে চমৎকার পাঞ্জাবি আর সিল্কের চাদর, পায়ে চকচকে পাম্পশু মুখে একটি সিগারেট আর মৃদু হাসি।
যাহারা ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল তাহাদের কেহ দূরে সরিয়া দাঁড়াইল, কেহ সেখানে থাকিয়াই বুকের ওপর দুই হাত রাখিয়া এমনভাবে চাহিল, তাহাদের মতো তাহারাও চলিয়া বাইবে না, মারিয়া ফেলিবে না তো আর! ইহারা নবীন। যাহারা প্রৌঢ়া অথবা বৃদ্ধ তাহারা দূরে দাঁড়াইয়া হাসিল। ইহাদের স্পর্ধা তো কম নয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন সবটাতেই একটা বাহাদুরি দেখানো চাই। বাবু সেলাম। ইয়াসিন একটা সেলাম দিয়া বলিল, আজ জীবনের শেষ ঘন্টাগুলি ঢং ঢং করিয়া বাজিতেছে, এতকাল যে সেলামের জোরেই সে সকলের প্রিয় হইয়া আসিয়াছে আজও তাহার অন্যথা হইবে না।
বাবু সেলাম গ্রহণ করিলেন এবং মৃদু মৃদু হাসিলেন।
২.
খবরে যদিও জানা গেল লোকটি কোনো এক কাপড়ের কলের ম্যানেজার—অর্থাৎ একেবারে বড়ো কর্তা, মিলের জন্য এখানে লোক সংগ্রহ করিতে আসিয়াছে তবু তাহার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মতভেদের অন্ত রহিল না।