এইবার হাসিবার পালা বাসন্তীর। সে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে লাল হইয়া গেল।
–বারে! তুমি হাসছ যে?
—তুমি একটা আস্ত গাধা। পৃথিবী আবার কোনোদিন গোল হয় নাকি? চোখ দুটো ছোটো করিয়া, একটা পা উঠাইয়া একটু কাত হইয়া বাসন্তী বলিল, তাহলে এই যে দাঁড়িয়ে আছি, পড়ে যাব না?
তপন রাগিয়া বলিল, চল বাবার কাছে যাই। কী বলেন। কিছু জানলে তো বুঝবে? আবার হাসা হচ্ছে! অত হেসো না কিন্তু, তা হলে আমি কথা বলব না। আবার হাসছ যে! বেশ, এখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার আড়ি।
তপন নীরবে চলিতে লাগিল।
বাসন্তী হঠাৎ পিছন ফিরিয়া বাড়ির পানে দৌড়াইতে লাগিল। তপন ভয় পাইয়া গেল। পিছনের দিকে দৌড়াইতে দৌড়াইতে বলিল, বা, তুমি দৌড়াচ্ছ যে? যাবে না ঝরনা দেখতে? বাসন্তী মুখ ফিরাইয়া বলিল, থাক এখানে পড়ে।
কতদূরে গিয়ে বাসন্তী বসিয়া পড়িল। মুখ লাল হইয়া গিয়াছে রোদে-আমার সঙ্গে পারবে দৌড়াতে? তোমার মত মানুষে না, হাঁপাইতে হাঁপাইতে সে বলিল।
তপন তাহার পায়ের কাছে ঘাসের উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বাসন্তীর পানে চাহিয়া বলিল, হুঁ, পারব না আবার! জান আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম ভালো দৌড়বার জন্যে।
বাসন্তী নতুন একটা কথা শুনিল, সব ভুলিয়া আগ্রহের সহিত তপনের গলা দুই হাত দিয়া জড়াইয়া বলিল, পাইজ! কী তপু!
তপন বিজ্ঞের হাসি হাসিল, প্রাইজ! পাইজ আবার কাকে বলে? আচ্ছা বোকা তুমি! কিচ্ছু জান না। বললাম, প্রাইজ, না পাইজ! কতকগুলো বই বা অন্য জিনিস এমনি দিয়ে দেয়, ওকেই বলে প্রাইজ। কত ছবি কত গল্প থাকে ওর মধ্যে। আনলে তোমাকে দেখাতাম! বাসন্তী উপরের দিকে একবার চাহিয়া বলিল, ইস, কত বেলা হয়েছে! সূর্যি একেবারে মাথার উপরে উঠেছে। বাবা দেবেখন আজকে আমায়। চল, শীগগির চল।
বাড়ির কাছে আসিতেই চোখে পড়িল, এক মহা হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছে। বাসন্তীর বাবা তাহাকে দেখিয়া রাগতস্বরে বলিল, এই যে, এতক্ষণে আসা হয়েছে! পরের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হয়েছিল, শুনি? দাঁড়াও, আজ তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। পান্ডাটি একটা কঞ্চি লইয়া অগ্রসর হইল। বাসন্তী ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল! শব্দ হইল, সপাং, সপাং–
—আমি আর যাব না বাবা। আমায় এরকম করে মেরো না। বলছিই তো আর যাব না—না—
তপনের দুটি ভয়ব্যাকুল চোখ ছলছল করিতে লাগিল। এমন সময় অবিনাশ ফিরিয়া আসিলেন। একবার তপনের দিকে চাহিয়া পান্ডাটির কাছে গিয়া বলিলেন, ওকি করছ? আহা ও রকম করে মারতে আছে! এই তোমাদের দোষ, মারতেই শুধু জান।—শব্দ থামিল। বাসন্তী ফুপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। সেদিনই অবিনাশ চলিয়া গেলেন। পথে তপন জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, ওরা এরকম করে মারে কেন বাবা? তুমি তো আমাকে মারোনি কোনোদিন।
–খুব মেরেছে নারে? অবিনাশ কহিলেন। পরের দিন আবার তাহারা আসিল, কুমারী পূজা দিতে। বাসন্তী দূর হইতেই তিনজনকে দেখিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া গেল। কাছে আসিলে সে তপনের হাত ধরিয়া টান দিল। অবিনাশ পিছন ফিরিয়া একটু হাসিলেন, তারপর চলিয়া গেলেন।
বাসন্তী বলিল, ঝরনা দেখতে যাবে তপন! কালকে যে তুমি দেখতে চেয়েছিলে!
তপন ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, কাজ নেই, আবার তোমায় মারবে যে!
থামিয়া পুনরায় কহিল, জান, আমরা কুমারী পুজো দিতে এসেছি, কে কুমারী হবে বল তো?
—জানিনে।
–দূর বোকা, তুমি কিছুই বলতে পার না। বাবা বলেছে কুমারী হবে তুমি। বাবা তোমার জন্য নূতন কাপড় এনেছে।
বাসন্তীর মুখ খুশিতে ভরিয়া গেল।
পূজা হইতেছে। তপন মুগ্ধ চোখে দেখিতেছিল। এমন আর সে কখনও দেখে নাই। নূতন কাপড় পরিলে বাসন্তীকে কি সুন্দরই না দেখায়। রৌদ্রে ঝলমল। করিতেছে কাপড়, বিচিত্র গৌরবর্ণ মুখ লাল হইয়া গিয়াছে।
পূজা শেষ হইলে তপন হাত নাড়িয়া তাহাকে ডাক দিল। বাসন্তী মুক্তি পাইয়া। যেন দৌড়িয়া আসিল।
-কেন ডাকছ?
তপন হাসিয়া বলিল, তুমি কী সুন্দর, না? নূতন কাপড় পরে থাকবে কিন্তু।
–দুর, সবসময় বুঝি নূতন কাপড় পরে থাকে? তপন তাহার কথায় কান দিল না, কী যেন চিন্তা করিয়া বলিল, চল, ওদিকটায় যাই।
বাসন্তী তৎক্ষণাৎ রাজী হইয়া বলিল, চল।
কিছুদূর গিয়া তাহারা থামিল। সম্মুখে একটা গাছ ডালপাতা লইয়া অনেকটা জায়গা জুড়িয়া দাঁড়াইয়া আছে।
তপন বলিল, দাঁড়াও এখানে। পাতা দিয়ে মুকুট বানাতে পার তুমি?
–না।
তপন কতকগুলা সরু সরু লতা ছিড়িল আর ছিড়িল অজস্র বুনোপাতা। তারপর পাতার উপর পাতা গাঁথিতে লাগিল। এবং শিশু কারিগরের হাতে নির্মিত হইল একটা মুকুট। সে একবার মুখের কাছে মুকুটটা ধরিয়া হাসিয়া উঠিল। শিশু বৈজ্ঞানিক নিজের কৃতকার্যতায় বেজায় খুশি।
মুকুটপরিহিত বাসন্তীকে চমৎকার দেখাইল। দুই-একগোছা নরম চুল বাহির হইয়া রহিল। বাসন্তী ঋজু হইয়া দাঁড়াইল ও তপন তাহার পায়ের কাছে বসিল। পকেট হইতে সে একটা ছোট্ট ক্যামেরা বাহির করিল। বিস্মিত হইয়া বাসন্তী জিজ্ঞাসা করিল, এটা কী তপু?
তপন ক্যামেরাটা খুলিতে খুলিতে বিজ্ঞের মতো বলিল, দেখেছ কখনও? ছবি তোলা যায় এটা দিয়ে। আমি তোমার ছবি তুলব, খুব মজা হবে, না!
—হুঁ। একটা ছবি দেবে আমায়!
তপন হাসিয়া বলিল, আর কাকে দেব, বল? ঢাকায় গিয়ে প্রিন্ট করে পাঠিয়ে দেবখন।