টিলার উপরে উঠিবার সময় তপন ক্লান্ত হইয়া পড়িল। ঘর্মাক্ত মুখে লাল আভা পড়িয়া তাহাকে ভারী সুন্দর দেখাইল। কিন্তু ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে ক্লান্তিকে স্বীকার করিতে চায় না। কী যেন একটা ইংরেজি ছবিতে সে দেখিয়াছিল কতকগুলা লোককে সাদা বরফের পাহাড়ে উঠিতে। তাহার মধ্যে একটা বালক একজনের কোমর ধরিয়া কেমন সুন্দর মার্চ করিবার ভঙ্গিতে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া উপরে উঠিতেছিল। এক নিবিড়ো সুখের অনুভূতিতে তপনের মনের শিশু আনন্দে নাচিয়া উঠিল। সে ছবির খোকাটির মতো বাবার কোমরের জামাটা হিচড়াইয়া টান দিল। অবিনাশ মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন ও কী হচ্ছে রে? আমার হাত ধরে আয়। কষ্ট হচ্ছে বুঝি উঠতে?
তপন তাচ্ছিল্যের সহিত ঠোঁট উলটাইয়া তেমনিভাবে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া বলিল, এরকম করে পা ফেলতে পারবে তুমি? কোথেকে পারবে, জানলে তো পারা যায়?
উপরে উঠিলে পর পান্ডারা ঘিরিয়া ধরিল। থাকিতে হইবে কিন্তু একজনের বাড়িতেই। কাছে একজন নিরীহ গোছের পান্ডা দাঁড়াইয়া ছিল। চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে আর সকলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত গরিব। অবিনাশের চোখ পড়িল তাহারই উপরে। সেই পান্ডাটা তাহার দৃষ্টিপথে পড়িয়া বলিল, বাবু আমার কাছে আসুন। অবিনাশ খুশি হইয়া বলিল, চল। আয়রে তপু।
বাড়ির উঠানে পা দিতেই নবাগতদের চোখ পড়িল একটি মেয়ের উপর। দশ বছর বয়স। উপুড় হইয়া কতকগুলা মটির পাত্রে কী যেন রাঁধিতেছিল। ছোটো ছোটো কোঁকড়ানো চুলওলা ছড়ানোকপালে, কানে, পিঠে।
পায়ের শব্দে চাহিয়া মেয়েটি গম্ভীরভাবে কহিল, এসেছ? আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম বাবা, কবে রান্না হয়ে গেছে। এখনও তোমাদের জন্য আমি বসে আছি। আমার দিকেও তো চাইতে হয় বাপু। খেটে খেটে হয়রান হলুম।
পান্ডাটি মেয়ের কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া উঠিল। অবিনাশের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দেখেছেন বাবু? মেয়ে আমার কেমন পাকা গিন্নী, অবসর পাচ্ছে না এখনও, কী উপায় করি বলুন তো?
পিতার গলার অনুকরণ করিয়া মেয়ে বলিল, কী উপায় করি বলুন তো! না আমার আর সয় না বাপু! খাবে তো এস, না হয় আমি সব ফেলে দিই। অবিনাশের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবু, আপনারাও আসুন। অবিনাশ স্মিতমুখে বলিলেন, আসব, মা আসব। তপন মুগ্ধ চোখে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, কী সুন্দর! মনে মনে ভাবিতে লাগিল : সে তো তাহাদের পাড়ার কত মেয়েকেই দেখিয়াছে, কিন্তু এই মেয়েটির মতো সুন্দর কেহই নয়। তপন ফিরিয়া আস্তে আস্তে তাহার কাছে গিয়া বলিল, কেন ডাকছ আমায়?
–বস, বলিয়া সে হাত টানিয়া বসাইয়া দিল।
–তোমার নাম কী?
—তপন!
–বেশ নাম তো! তুমি কি বোকা! আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন করলে না? আমার নাম বাসন্তী। কেমন, আমার নাম ভালো কি না বল? না, তোমায় বলতে হবে, আমি যে বললাম।
তপবন হাসিয়া বলিল, বেশ ভালো নাম।
বাসন্তী বলিল, খাবে কিছু? দাঁড়াও আমি বেড়ে দিচ্ছি। মাটির পাত্রে ভাত, আগাছার ঝোল, চচ্চড়ি দেওয়া হইল। তপন হাত দিয়া মাখিয়া মুখের কাছে নিয়া ফেলিয়া দিল।
বাসন্তী হাসিয়া বলিল, দূর! অমন করে বুঝি খেতে হয়? তুমি একটা বোকা! মুখ সত্যি সত্যি খাওয়ার মতো করে নাড়তে হয় না? তা না করলে খাওয়া হল কী করে? খাওয়া শেষ হইলে তপন বাসন্তীর দিকে চাহিলে বাসন্তী বলিল, পেট ভরেনি বুঝি? তা না ভরলে আমি আর কী করব বল।
তপন হাসিয়া বলিল, তা হলে উঠি।
–আঃ দুধ যে রয়েছে, তা একেবারেই ভুলে গেছি। এই বলিয়া বাসন্তী একটু চুনমেশানো জল পাতের উপর ঢালিয়া দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খেয়ে লও, মা দেখলে বকবে। চুন যে চুরি করে এনেছি। খেয়ে আবার হাত ধোবে চল। এঁটো তো! জল আমাদের কোথেকে আনতে হয় জান? অনেক দূরে একটা ঝরনা আছে, ওখান থেকে আনতে হয়। যাবে দেখতে, কী সুন্দর দেখবে!
তপন ঝরনার প্রসঙ্গে খাওয়ার কথা ভুলিয়া গেল। বলিল, চল, এক্ষুনি চল। বাসন্তী ও তপন চলিল। চলিল দুটি স্বল্প-পরিচিত বালক-বালিকা, ছোটো নরম পা ফেলিয়া, শিশুসুলভ কথাবার্তা কহিয়া, কলহাস্যে হাসিয়া। কেহই জানিল না, কোন কাহিনি তাহাদের মধ্যে গড়িয়া উঠিতেছে, কেহই ভাবিল না, এতটুকু সময়ের পরিচয়ের মাঝে তাহারা কেমন করিয়া পরস্পরকে এত আপনার বলিয়া গ্রহণ করিল। কেমনে বলিব, এই দুটি বালক-বালিকার মনের ভাষায় কত যুগের ইতিহাস। তাহাদের বাক্যতরঙ্গে ফুটিয়া উঠে পৃথিবীর সকল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না–চাঁদের আলোর মতো নরম, নীল আকাশের মতো সুন্দর।
যাইতে যাইতে বাসন্তী একটা বুনো গাছের দিকে আঙুল বাড়াইয়া বলিল, এ রকম গাছ দেখেছ কখনো?
তপন বলিল, না। সব গাছই কি আর শহরে দেখা যায়! তুমি বুঝি শহরে কোনোদিন যাওনি?
—কে বললে তোমায়, আমি যাইনি? গৌহাটী গিয়েছি না!
তপন জোরে হাসিয়া উঠিল, বলিল, ছেঃ, গৌহাটী আবার একটা শহর! গোরা সৈন্য দেখেছ কখনো?
–না।
—ব্যস। কেমন ঠকিয়ে দিলাম।
বাসন্তী অপ্রতিভ হইয়া গেল। কতক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি। তোমাদের বাড়িতে কার সঙ্গে খেল?
—কত ছেলে আছে আমাদের ইস্কুলে। তাদেরি সঙ্গে খেলি।
–ইস্কুল! ইস্কুলে কী পড় তোমরা? তপনের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলিয়া গেল, একটু চিন্তা করিয়া বলিল, পড়ি কী জান? পড়ি, পৃথিবীটা গোল।