–দুত্তোর, বানিয়ে আবার খেলা যায় নাকি?
সরযুর ডাক আসিল, ওরে তপু, খাবি আয়।
তপু জুতা পায়েই মসমস করিয়া খাবার ঘরের কাছে গিয়া বলিল, যা দেবে দাও, আমার হাতেই দাও পিসিমা, বাইরে থেকেই খেয়ে যাই। সরযু ব্যস্ত হইয়া বলিল, না, ওসব হবে না বাপু, এ আমি বলে রাখছি। জুতো ছেড়ে ভিতরে বসে খেয়ে যাও। তপু বিরক্ত হইয়া বলিল, আজ যে আমাদের ক্রিকেট ম্যাচ, তা জান না বুঝি?
-আচ্ছা তা পরে হবেখন, আগে খেয়ে নে বলছি? অগত্যা তপু জুতা ছাড়িয়া খাইতে বসিয়া গেল। একটু পরেই তাহাকে উঠিয়া যাইতে দেখিয়া সরযু বলিয়া উঠিলেন, ওকি রে, উঠছিস যে, সবটুকু খেয়ে যা। আমি আর পারিনে, কী দস্যি ছেলে বাবা! কালই আমি তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তপু যাইতে যাইতে বলিল, তাহলে বেশ হবেখন, মজা করে খাব আর ঘুরে বেড়াব।
পরের বৎসর। বর্ষাকাল। বিদ্যুৎ চমকাইয়া মেঘ ডাকে। ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি আসে। বিশ্বপ্রকৃতি মুখর হয় ঘন কালো আকাশের অবিশ্রান্ত বারিপতনের অপরূপ শব্দে। এমন দিনে অতর্কিতে অবিনাশের এক বন্ধু আসিলেন। বলিলেন, চল অবিনাশ, আসামের হিল সেকশনটা দেখে আসি। যাবে? সে এক মজার জিনিস দেখতে পাবে। বৃষ্টিতে একটু কষ্ট হবে বটে।
তপনের তখন গ্রীষ্মের ছুটি। অবিনাশ যাইতে স্বীকৃত হইলেন। তপনও সঙ্গে গেল। তাহার মুখে খুশি আর ধরে না—নতুন দেশ দেখিতে পাইবে বলিয়া!
গৌহাটিতে গাড়ি পৌঁছিলে পর তপন বলিয়া উঠিল, এখানে সব টিনের ঘর কেন, বাবা? খুব গরিব বুঝি ওরা? ইট দিয়ে দালান বানাতে পারে না? অবিনাশ হাসিয়া বলিলেন, এখানে সবাই টিনের ঘরে থাকে। আমাদের চেয়ে বড়োলোকও, গরিবও।
বন্ধুর এক আত্মীয়ের বাসায় তাহারা উঠিল। আত্মীয়টি খুব আদর-যত্ন করিলেন, এই দূর দেশে নতুন একটি বাঙালির মুখ দেখিয়া। ভদ্রলোকের নম সতীশ। এক স্ত্রী, ছেলেমেয়ে হয় নাই, তিনি সকলের খাওয়ার আয়োজন করিতে লাগিলেন। সতীশ অভ্যগতদের স্নানের আয়োজন করিয়া দিয়া এক ফাঁকে রান্নাঘরে আসিয়া হাসিয়া বলিলেন, অতিথি খাওয়াতে তুমি খুব আমোদ পাও বীণা, এটা আমি জানি। কেমন, আজ পেলে তো? দূরে আছ বলেই ওদের খাওয়ানোর এত শখ। বাংলাদেশে থাকলে অতিথিসেবা কোথায় উঠে যেত! সতীশ মৃদু হাসিতে লাগিল।
বীণা মুখটি তুলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, হুঁ, চল না দেশে। দেখিয়ে দিই কাকে বলে খাওয়ানো। পুরুষ তোমরা, তোমরা কি বুঝবে একটি মানুষ খাইয়ে আমাদের কত সুখ!
সতীশ দুই হাত তুলিয়া বলিল, থাক, আর বলতে হবে না। কিন্তু মানুষ খাওয়ানোর অজুহাতে যেন এই অসহায় ক্ষীণ দেহটার উপর অবিচার করে বস না, এইটুকুই আমার অনুরোধ। তাহার কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া বীণা হাসিয়া ফেলিল। সতীশ তাহার মুগ্ধ আঁখি দুটি কর্মরত নারীটির উপর স্থাপন করিয়া বলিল, বাঃ, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে তোমাকে! দেখাবে না, সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা কি না—বিশেষত আজকের এমন একটা দিনে। তাই ভাবি, ভগবান যে আমায় এত সুখ দিলেন, এত সুখ আমি রাখব কোথায়? আচ্ছা তুমিই বল বীণা, এত ঐশ্বর্যের মাঝে দাঁড়িয়েও কীসের অভাবে মনটা আরও নিবিড় হতে পারে না?
অভ্যগতদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সতীশ আর দেরি না করিয়া চলিয়া গেলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর বীণা তপনকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার নাম কী খোকা?
—তপন।
–তোমার মা নেই বুঝি?
নরম জায়গায় আঘাত পড়িল। তপনের মুখ করুণ হইয়া গেল। সে বলিল, আমার মা-র কথা বলছেন? যখন আমার বয়স তিন বছর তখন তিনি মারা যান। আমাদের বাসায় গেলে দেখবেন মা-র মস্ত বড়ো একটা ফটো। এতবড়ো ফটো আপনি দেখেননি কখনও। বাবা রোজ ভোরবেলায় মার দিকে চেয়ে কি যেন বলেন। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও একটা ছোটো ফটো সব সময়েই ওঁর কাছে থাকে। আনব বাবার কাছে বলে? এই সরল ছেলেটির কথায় বীণার মুখ অবিনাশের প্রতি প্রশংসায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। সে সস্নেহে তপনকে বুকের কাছে টানিয়া বলিল, ফটো অন্য সময় দেখিও তপু, কিন্তু তোমার বাবা যেন না জানেন। এমন সময়ে অবিনাশ ছেলেকে খুঁজিতে খুঁজিতে শেষে তাহাকে এই অবস্থায় দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। নিরুদবেগ প্রশান্ত মুখ সরল হাসিতে ভরিয়া গেল।
কয়েকদিন পরে একদিন ভোরবেলায় অবিনাশ সতীশকে ডাকিয়া বলিলেন, আজ কামাখ্যায় যাওয়া যাক, কী বলেন? সতীশ হাতজোড় করিয়া মাপ চাহিবার ভঙ্গিতে বলিল, ঐটিই আমাকে মাপ করবেন অবিনাশবাবু, কাছ থেকে এত দেখেও যার ঘেন্না না ধরে সে তাহলে মানুষ নয়। আপনি একলা গিয়েই না হয় উপলব্ধি করে আসুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিই।
যাইবার সময় বীণা তপনকে ডাকিয়া বলিল, আবার আজকেই ফিরে এস কিন্তু তপু। তপন হাসিয়া বলিল, আর যদি আজকেই না ফিরি?
-তাহলে তোমার সঙ্গে আড়ি। একটি দিনের তরেও কথা কইব না-বীণা বলিল।
একেবারেই যদি না ফিরি বেশ মজা হবে তাহলে না? দেখাও হবে না, আড়িও চলবে না কেমন? দুজনেই হাসিয়া ফেলিল।
তাহারা রওনা হইল।
দুই পাশে পাহাড়, বড়ো বড়ো গাছ। মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়ি এবং তাহাদের মধ্যে আঁকা-বাঁকা পথের উপর দিয়া অবিনাশও তখন মন্থর গতিতে হাঁটিতেছিল। কামাখ্যার মন্দিরে পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। পাহাড়ের উপর মন্দির, সেখানেই পান্ডাদের বাড়ি, তাহাদের অবস্থা ভালো। তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়া কুমারী পূজা করে। কুমারী হয় পান্ডাদের মেয়েরাই।