-না, না, আমাকে আর ডেকো না। এই বয়সে আর অত সোহাগের ডাক ভালো লাগে না। একটা রাতও……।
-অত অহংকার ভালো নয়।
–আরে, এতে অহংকারের কী হল?
শ্রীবিলাস শক্ত গলায় বললে, তুই কি সারারাত ওখানেই দাঁড়িয়ে কাটাবি?
তুই সম্বোধন আরম্ভ হল।
বিন্দু চুপ করে রইল।
-আমি চোখে দেখতে পাই না বলে মজা পেয়েছিস বুঝি? খুব মজা না, খুব মজা?
কাছেই ছিল লাঠি, শ্রীবিলাস ভয়ানক রেগে সেটা ছুঁড়ে মারল আন্দাজে।
বিন্দু এবার হেসে উঠল। লাঠিটা গায়ে লাগেনি। সে তা উঠিয়ে রেখে দিলে ঘরের এক কোণে।
শ্রীবিলাস উঠে দাঁড়াল, কাঁপতে কাঁপতে বিন্দুকে ধরবার জন্যে রুখে এল, কিন্তু বিন্দু নিঃশব্দে সরে এসেছে আর একদিকে।
একটা পুরনো বাক্সের সঙ্গে শ্রীবিলাস খেলো ধাক্কা, আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর, আশ্চর্য—কেঁদে উঠল ডাক ছেড়ে, আমাকে মেরে ফেললে রে, ওই রাক্ষুসি আমাকে মেরে ফেললে রে!
আশেপাশে অনেক লোকজন, তারা শুনতে পেলে কী মনে করবে, হয়তো ভিড় জমাবে এসে এই রাতে, বিন্দু ভয় পেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি শ্রীবিলাসের কাছে এল, হাঁটু গেড়ে বসল, তার হাত ধরে বললে, চুপ চুপ! কেন অমন করছ? এই দ্যাখো, আমি একটুও ভয় পাই না তোমাকে।
শ্রীবিলাসের চেঁচামেচি এক মুহূর্তে গেল থেমে, ব্যথা গেল উড়ে।
বিন্দু দরজা বন্ধ করল।
আবার ভোরও হল, কেউ না উঠতেই শ্রীবিলাসও উঠল, আকাশে না-দেখা সূর্যকে প্রণামও করল, পরলোক-বিষয়ক একটি গানও ধরল।
অমিল
অভিনয় শেষ। গ্রিনরুমে এসে সমবেত হয়েছে। স্থান অল্প, লোক বেশি। অভিনয় ব্যাপারে এত পরিশ্রমের পরেও অজস্র কথার গতিতে মুখের রঙ তোলার বা পোশাক পরিচ্ছদ বদলানোর তাড়া নেই।
স্থান সল্পতা স্বত্ত্বেও ঘরের এক কোণে একটু নিরিবিলি আছে। মেয়েদের সেখানে আনাগোনা কম, কিন্তু ভারতী এসেই সে স্থানটুকু বেছে নিয়েছে। অত গোলমাল আর তার ভালো লাগে না। ভারতী তাই একটা লোহার চেয়ারে চিবুকে হাত রেখে বসে মজলিশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চুপ করে আছে।
কিন্তু কোনোরকমেই রেহাই পাবার উপায় নেই। রেখা কোত্থেকে এসে ধরল।
–ইস, ভাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান! এমন করে একলাটি বসে। আছিস কেন বল তো?
ভারতী হেসে বললে, এমনি!
তোর সবই, তো এমনি, সে যাক, একটু বসতে দে আগে, আমি আর দাঁড়াতে পারছিনে।
—জায়গা কোথায়?
–একটু সরলেই হবে— কোনোরকমে জায়গা করে রেখা তার পাশে বসল। রানির ভূমিকাভিনয়ে ছিল ভারতী। তাই জমকালো হয়ে সাজতে হয়েছিল। রানির পরিধানযোগ্য অনেক ধরা-চূড়া। কিন্তু একটি জিনিসও ভারতীর নিজের নয়, সব এই রেখার দেয়া। সে কোথায় পাবে? মেয়েরা তাকে একদিনের জন্যও একটা ভালো কাপড় পরতে দেখেনি। তারা জানে এর মূলে কী!
ভারতী বললো, তোর জিনিসগুলো–
রেখা আর বলতে দিল না, তার মুখে হাত চেপে বাধা দিয়ে বলল, ওসব কে এখন শুনতে চাইছে? একসময় দিলেই হবে।
-না, দামি জিনিস তো!
ইস আমি পারিনে। এখানে কি এমন কেউ নাই যে আমাকে এই nonsense talk থেকে রেহাই দিতে পারে। রেখা অভিনয়ভঙ্গিতে বলল।
ভারতী নীরবে হাসল।
ভারতীকে জড়িয়ে রেখা বললে, তোর মতো রূপও যদি আমার থাকত তবে দেখতিস।
কথাবার্তায় রেখার প্রকৃতিই ওই রকম, সবসময় কেবল সৌন্দর্যচর্চা। একটু পরে বলল, থিয়েটার কেমন হল?
দু-চার বছরেও এমন হয়নি।
খানিকটা পরে : অঞ্জন আসবে লিখেছে।
ভারতী বললো, শুধু এই? আর কী লিখেছে বল? লিখেছেঃ পাইনের মর্মর ভুলতে পারো কি? আমাকে তো অনেকগুলো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাদের ভাষায় আমি এক অতিপরিচিত ভাষাই শুনতে পাই। আমার ভালো লাগে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তটিকে কী নামকরণ করব বলো, যখন মনে হয়, যা অতীত তা তো আর আলোক নয়, শুধু অন্ধকার? অন্যদিকে চেয়ে কতকটা স্বগতভাবে রেখা বলল,-এমন সরল স্বভাব, এমন হাসি!
ভারতী পরিহাসচ্ছলে বলল, কালো অঞ্জন মেখেছিস চোখে! কিন্তু আমার তো হিংসে হওয়ার কথা।
-তা হোক, তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমার ভয়ানক, খিদে পেয়েছে।
রেখা আশ্চর্য হয়ে বলল, কেন, তুই খাসনি? চা?
-ওসব আমার ভালো লাগে না।
–তুই একটা অদ্ভুত প্রাণী। চল, এলাদির কাছে গিয়ে বলি।
ভারতী তার হাত ধরে বলল, দোহাই তোর, তুই এখান থেকে যাসনে। অত গোলমালে আমার মাথা ধরে গেছে। এখানে বেশ ভালো আছি, তুই বরং গল্প কর।
ভারতী খানিক থেমে বললে, এলে কিন্তু আমায় দেখাবি।
-আচ্ছা।
–তখন আমার দুঃসময়। তুই তো আমাকে ভুলেই যাবি।
–তা তুই ভাবতে পারিস, তোর মতো নেমকহারাম দুটি আছে? ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, কী দোষটা করেছি শুনি?
-দোষ? কতদিন বললাম আমাদের বাসায় যেতে! বন্ধু বলে আমারই ঠেকা বেশি, না?
-না, কে বললে অমন কথা? কখনও নয়। ঠেকা আমারই বেশি। কিন্তু তোকে আমাদের বাসায় নিইনে কেন জানিস? সেখানে গেলে তুই শ্বাসরোধ যন্ত্রণায় মারা পড়বি।
রেখা গম্ভীর হয়ে বললে, তুই আমাকে ঠাট্টা করিস?
—মোটেই না। জ্বলন্ত সত্য কথা।
রেখা গম্ভীর হয়েই রইল। ভারতী তার হাতটি বুকের কাছে টেনে বলল, কাল এক মজার ব্যাপার ঘটেছিল। শেষরাতে হঠাৎ জেগে দেখি, ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ঝরঝর একটানা শব্দ। কী যে ভালো লাগলো বলতে পারি না–
রেখা আর চুপ করে থাকতে পারল না। তাড়াতাড়ি বলল, একেবারে মিলে গেছে। আমিও জেগে উঠেছিলাম কিন্তু। তোরই মতো ভালো লেগেছিল আর মনে হয়েছিল, ভারতী এখন কী করছে কে জানে? এখন যদিও থাকত আমার পাশে, শেষ রাতটুকু অনেক কথা বলে কাটিয়ে দিতাম।