তখন রাত্রির শেষ প্রহর। লোক এখন আগের মতো নাই। রতনের চোখের নিবিড়তা আরও গভীর হইয়াছে, বুক ভরিয়া নিঃশ্বাস উঠিতেছে। সে উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু এ ঘর-সে ঘর ঘুরিয়াও যাহাকে খুঁজিতেছিল তাহাকে পাইল না। ললিতা নাই। রতন তাড়াতাড়ি আঙিনায় আসিয়া দেখিল চিত্তও নাই।
সে রাগে ঠোঁট কামড়াইতে লাগিল ভাঙা জ্যোৎস্লাঙ্কিত পথের উপর দিয়া তাড়াতাড়ি নদীর খেয়াঘাটে গেল। বর্ষার বিল, নদীর সঙ্গে এক হইয়া ধু-ধু করে।
শূন্যতায় বাতাস হা হা করে।
এই শেষ রাতের পৃথিবীতে রতন অনেকক্ষণ স্তন্ধের মতো দাঁড়াইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। দু-একটা জেলেনৌকা এদিক সেদিকে ঘুরিতেছে। তা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
রতন ফিরিয়া আসিল। আখড়া কিছু দূরে আছে। তাহার পিছনে একটা কুকুর আসিয়া জুটিল, সেটা হয়ত প্রথম হইতেই সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। রতন এই মুহূর্তে হঠাৎ উহাকে দেখিয়া ভয়ানক রাগিয়া গেল, পথ হইতে একটা ঢিল কুড়াইয়া চুড়িয়া মারিল কুকুরটার দিকে, কিন্তু লাগিল না। কুকুর পিছন দিকে দৌড় দিল।
তাহার এবার ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। সে আর একটা ঢিল লইয়া এবার এমন জোরে আর লক্ষ্যহীন ভাবে ছুঁড়িয়া মারিল যে কুকুরটা একবার ব্যথায় আর্তনাদ করিয়া সত্যি দৌড়াইয়া পালাইয়া গেল।
রতন তবু নিঃসন্দেহ হইবার জন্য কতোক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া লক্ষ করিল, কুকুরটা আবার আসে কি না। আসিল না। সে কতকটা নিশ্চিত হইয়া আগের জায়গায় গিয়া বসিল। এবং তখনও যে বাকি লোক অবশিষ্ট ছিল, তাহারা, বিনোদিনী ও আরও কয়েকটা মেয়ে অত্যন্ত বিস্ময়ে দেখিল : সুরে সুর মিলাইয়া রতন আজ গান গাহিতেছে।
ব্যাপারটা আশাতীত। আর সকলে গান থামাইয়া দিল। বিনোদিনী ঘর হইতে তাড়াতাড়ি একতারাটি আনিয়া রতনের হাতে দিল। সে সত্যই ভারী সুন্দর গান আরম্ভ করিল। বিনোদিনীর আজ খুশির অন্ত নাই; কারণ সে জানে, ললিতা চলিয়া গিয়াছে।
রানু ও স্যর বিজয়শঙ্কর
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু সান্ধ্যভ্রমণ শেষ হয়নি। পার্কের যেদিকটা জনবিরল সেখানে কখনো লাল কাঁকরের পথে, কখনো নরম ঘাসের উপরে স্যর বিজয়শঙ্কর নীরবে পায়চারি করছিলেন। অদূরে মানুষের ভীড় থেকে, যানবাহন পীড়িত পথের চলায়মান জনতা থেকে, একটানা কোলাহল শোনা যায়। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল আলো এসে পার্কের দেহাবরণ খুলে সমস্ত প্রকাশ করে দিয়েছে।
স্যর বিজয়শঙ্কর নিজের মন এদিক-সেদিক হাঁটছিলেন।
-বাবা, ও বাবা!
কান্নায় বিকৃত একটি ছোট্ট মেয়েলি স্বর যেন কাছে কোথাও শোনা গেল! স্যর বিজয় থমকে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হলেন।
-আপনি আমার বাবাকে দেখেছেন?
মেয়েটি তাঁর কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে—ফ্রকপরা, স্যর বিজয়শঙ্কর চশমা-চোখে সেই স্বল্পালোকেই তাকে দেখলেন। ঘাড় পর্যন্ত চুল, দু-হাত আর পা নিরাভরণ, মুখ চোখের জলে ভেজা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে কাঁদছে।
-বলুন না, আমার বাবাকে দেখেছেন?
স্যর বিজয় তার ছোটো একটি সরু হাত ধরে বললেন, তোমার বাবা বুঝি হারিয়ে গেছেন?
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললে,—বাবা আমায় খুব ভালবাসে কি না, আমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে এমনি বেড়াতে আসি, আজও এলাম, কিন্তু বাবাটা কি দুষ্টু, আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেল, আমায় একবার ডাকলও না, আমি কত খুঁজলাম, এমন দুষ্টুমিতো বাবা কখনো করে না। আমি তো আর সব পথ চিনি না, কেমন করে বাবাকে খুঁজে বের করি! আপনি দেখেছেন আমার বাবাকে?
স্যর বিজয়শঙ্কর তার মাথায় হাত রেখে বললেন, দেখিনি, কিন্তু খুঁজে বার করে দেব, তুমি কেঁদো না খুকি। আচ্ছা, তোমার বাবার কেমন চেহারা বলো তো?
–আপনি যেমন লম্বা না, ঠিক এমনি লম্বা। কিন্তু আপনার মতো দাড়ি-গোঁফ নেই, আর থাকবেই বা কেন, আপনার মতো বুড়ো তো নয়—কিন্তু আমি একদিন দুপুরবেলা দেখেছি, মাথায় ছোটো একটা টাক, চুল পেকেছে খুব, আমি কত ফেলে দিই তবু পাকে!
কথার বেগে মেয়েটির কান্না কমে আসছিল। স্যর বিজয় পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে সস্নেহে মেয়েটির চোখের জল মুছে দিলেন। বললেন, খুকি, তুমি কেঁদো না। কোনো ভয় নেই, আমি তো আছি, তুমি কেঁদো না। আমি তোমার বাবাকে খুঁজে বার করে দেব।
মেয়েটি তাঁর মিষ্টি কথা শুনে, আর চেহারার আভিজাত্য, গাম্ভীর্য দেখে কতকটা আশ্বস্ত হয়েছিল। ঘাড় কাত করে বললে, কলকাতার সব রাস্তা আপনি চেনেন?
কী একটু ভেবে স্যর বিজয় হেসে বললেন, তা নাহলে আর এত বুড়ো হলাম। কেমন করে বল? সব রাস্তা চিনি।
মেয়েটি মনে মনে তাঁর যুক্তি স্বীকার করল।
—রূপসিং?
–হুজুর?
স্যর বিজয়শঙ্কর মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললেন, এসো।
প্রকান্ড গাড়ি। আর কেমন চকচক করে! মেয়েটি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। মাডগার্ডের ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, এটা আপনার গাড়ি! আমিও উঠব না?
—হ্যাঁ! স্যর বিজয় হাসলেন।
—কত দাম? তেমনি হাত বুলোতে বুলোতে সে জিজ্ঞাসা করলে।
স্যর বিজয় আবার হেসে বললেন, কুড়ি হাজার।
মেয়েটি আশ্চর্য হল না; কারণ কুড়ি হাজার কাকে বলে তা সে জানে না। কেবল চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগল।
–এসো। স্যার বিজয় ভিতরে গিয়ে বসে তাকে পাশে বসালেন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে বললেন, রূপসিং?