ললিতা খিল খিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল, বলিল, ও মা বলে কী গো। এত আমি সইব কী করে?
ললিতা হাসি চাপিয়া সুর ধরিল—
ওগো সুখের জোয়ারে ভাসিছে আমার মন ভাবি নাই কভু, লুকায়ে কোথা ছিল। এমন ক্ষণ।
ললিতা আলো জ্বালাইয়া দিল। এমন সময় রতন আসিয়া উপস্থিত।
রতন বলিল, চিত্ত এমন চুপ করে বসে থাকায় কী লাভ? গল্প করো। আমি বাপু মুখ বুজে থাকতে পারিনে, তোমরা একে দোষই বলো আর যাই বলো।
চিত্ত এতক্ষণে একটু হাসিল, বলিল, তুমিই বলো, আমার পুঁজিতে আর গল্প নেই।
–তা আমার বেলায় থাকবে কেন? রতন চকিতে একবার ললিতার দিকে চাহিয়া বলিল, সে থাক, আমিই বলি শোনো। আমি তখন আমাদের বাড়ি শান্তিপুরে থাকি, অনেকদিন আগের কথা, আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল, দিশি কুকুর, গায়ের রঙ সবখানেই কালো কেবল পা আর মুখ ছাড়া, সেখানে সাদা রঙ। মাঝারি গোছের দেহের আয়তন, পা দুটি খাটো, লেজটিও কে যেন কেটে দিয়েছিল। সে যাই হোক আমরা কুকুরটাকে খুব ভালোবাসতাম। ওটাও আমাদের খুব পোষ মেনেছিল, আমরা যা খেতাম সব ওকে দিতাম, দরকার হলে ভালো জিনিস আমিও ওকে খাওয়াতাম। ওর শোবার জায়গা পর্যন্ত করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য, একদিন হল কী, আমারই ছোটো বোনকে সে অনর্থক কামড়ে দিল। আমরা তো সকলেই অবাক, এ কেমন করে হয়!
ভিতরের ইঙ্গিত ধরিয়া কোনোরকমে বিরক্তি চাপিয়া চিত্ত উঠিয়া পড়িল, রতন ইহা দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত ধরিয়া বলিল,-যাচ্ছো কেন, শেষটুকু শুনে যাও!
-না, আমি যাই, আমার কাজ আছে!
—শুধু আমার বেলাতেই কাজ না? দাঁড়াও শেষটুকু তোমায় শুনতেই হবে। রতন হাত ছাড়িল না। মুখটি অস্বাভাবিক কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
-কী আরম্ভ করেছে গোঁসাই? ছেড়ে দাও আমি যাই। ললিতা স্তব্ধ হইয়া দেখিতেছিল। হাত না ছাড়িয়া রতন উষ্ণ স্বরে বলিল, তারপর আমরা ভাবলাম এ কেমন করে হয়। এতকাল যাকে বাড়ির লোকের মতই আদর করেছি, খাবার দিয়েছি, ভালবেসেছি, সে কেন এরকম করলে? কৃতজ্ঞতা বলে কোনো জিনিসই কী নেই? এ ছাড়া মানুষ বাঁচে কী করে? তাই যদি না থাকে তাহলে তো আমি তোমাকে মেরে ফেলতে পারি, তুমিও আমাকে মেরে ফেলতে পার, ললিতাও পারে। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, পৃথিবীতে এমন একশ্রেণির জীব আছে যারা খুব প্রিয়জনের বুকেও ছুরি বসাতে পারে, এতটুকু দ্বিধা করে না, যাদের শিরা উপশিরায় বিভীষণের রক্ত, চোখে কংসের দৃষ্টি, ওই তাদের মতো, যারা তলে তলে ভয়ানক খেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওপর দেখে কিছুই বোঝা যায় না। এ ছাড়া অন্য কিছুই না! চিত্ত আর পারিল না, জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।
ললিতা দ্রুত ঘরে গিয়া দু-হাতে চোখের জল চাপিল।
রতন ঘরের দিকে একবার চাহিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া স্তন্ধের মতো বসিয়া রহিল। এত রাগ তাহার কোনোদিনও হয় নাই।
বাহিরের অন্ধকার আরও গাঢ়তায় চাপিয়া আসিয়াছে। একটানা ঝি ঝি পোকার শব্দ। কিছুদূরে কামার বাড়ির লোহা ঠুকিবার আওয়াজ।
রতন দুই হাঁটুর উপর হাত রাখিয়া, তার উপরে মুখটি স্থাপন করিয়া বসিয়া রহিল। চোখ দুইটি তাহার অকারণ জ্বালা করিয়া উঠিতেছে।
একটু পরেই বিনোদিনীরা আসিল। রতন তখনও বসিয়া আছে। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া ঘরে গিয়া দেখিল, ললিতাও ওপাশের দরজায় চৌকাঠ ঘেসিয়া বসিয়া আছে, মুখ হাঁটুর ভিতরে। সে আন্দাজে কিছু একটা কল্পনা করিয়া মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, কী গো ঠাকরুণ, রাত বারোটা না একটা বেজেছে যে ঘুমে মুখ তুলতে পারছ না? আমরাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ গো! নিজের রূপের জ্বালায় দেখি চোখে-মুখে পথ দেখতে পাও না। অত অহংকার ভালো নয় বলে দিচ্ছি।
ললিতা তবু মুখ তুলিল না।
আঙিনা হইতে রতন বলিল, ঘুমুচ্ছে নাকি?
—হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আমি কী মিথ্যে বলছি? বিনোদিনী বাহিরে আসিয়া বলিল, বয়স তো আমাদেরও একদিন ছিল কিন্তু ভর সন্ধ্যায় ঘুম কাকে বলে সে তো কখনো জানিনি!
রতন সায় দিয়া বলিল, ওকথা আর বলো না বিনুঠাকরুণ, তোমার পায়ের ধুলোর যোগ্য তো ও নয়।
বিনোদিনী খুব খুশি হইয়া কাছে আসিয়া বলিল, এ বেলা শুধু দুধ খাবেন বলেছিলেন, এখন আনব?
-না থাক।—রতন তাহার হাত ধরিল। বিনোদিনী চারিদিকে একবার চাহিয়া নিজেকে ছাড়িয়া দিল।
কালীচরণ কথা রাখিল ঠিকই।
ঝুলন পূর্ণিমার রাত্রি। অনেক লোক জমা হইয়াছে। একটু বেশি রাতে কীর্তন আরম্ভ হইবে, এখন গল্প চলিতেছে, রতন রোজ যেখানে বসে সেইখানেই বসিয়া, আর চারিদিকে অন্যান্য সব লোক। সকলের শেষে গাওয়া হইবে। কালীচরণ এখন গাঁজার সরবরাহে ব্যস্ত।
সমস্ত লোকগুলির মাথার উপরে রাশি রাশি ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। মাঝে মাঝে মৃদু গুঞ্জন। রতনের আস্তে মিষ্টি কথা।
রাত্রি একটু বাড়িলে পর কীর্তন আরম্ভ হইল। রতন গান গায় না ঠিকই সে চুপ করিয়া বসিয়াছিল, ইতিমধ্যে চিত্তও কখন আসিয়া এককোণে নীরবে বসিয়াছে। রাগ করিতে সে পারে না। রতন তাহাকে লক্ষ করিল কিন্তু ডাকিয়া কিছু বলিতে পারিল না। সেদিনের ব্যাপারটা মনে করিয়া আজ তাহার সত্যি দুঃখ হইতেছে।
সময়ের কাঁটার চলার বিরাম নাই। উৎসবরত মানুষেরও সেদিকে খেয়াল নাই।
বাহিরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আলোর স্পর্শে বিবশ পৃথিবী। গাছপালা সব যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে রাত্রি বাড়িয়া চলে। কাহারও চোখে ঘুম নাই আজ। রতন তেমনি বসিয়া আছে, চোখ দুটি যেন কী এক নেশায় নিবিড়!