ললিতা উঠিয়া আসন আনিয়া দিল।
বসিয়া রতন বলিল, কালিচরণ আসবে বলেছিল, ওর জন্যেই কতক্ষণ বসে, কী আর করি, শুয়ে পড়লাম। ব্যাটার কী কথার ঠিক আছে, বলছে না ঝুলন পূর্ণিমার সময় খরচ করবে, দেখো সব মিছে কথা। তারপর তুমি যখন এসেছিলে কাউকে দিয়ে ডেকে আনলেই তো পারতে। দিনে ঘুম সইতে পারি না, পরে আর কিছুই ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ নিশ্চয়ই এসেছো? রতন টের পাইয়াছিল আগেই। চিত্ত সংক্ষেপে বলিল, হ্যাঁ।
রতন বলিল, ললিতাও আমারই মত। কুঁড়েমি কাকে বলে জানে না।
—তবে একবার গল্প পেলে-চিত্ত উঠিয়া পড়িল।
–যাচ্ছ?
–হ্যাঁ।
–আবার কখন আসবে?
–সন্ধ্যাবেলা।
চিত্ত চলিয়া গেল। রতন কতোক্ষণ তাহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিল, ললিতাও কখন সরিয়া গিয়াছে।
আজ অনেকদিন পরে আবার বিকেলবেলা চিত্ত পুকুর পারে ছিপ লইয়া বসিল। কাছে একটি লোকও নাই, কেবল পার ঘেঁসিয়া কয়েকটা গোরু ঘাস খাইতেছে।
বড়শি ফেলিয়া সে নিস্তরঙ্গ জলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।
আকাশে একটুকরো মেঘ নাই। বাতাসও নাই। পুকুরের চারদিকের গাছের পাতা নড়ে না। ওদিকের তালগাছটায় বসিয়া কয়েকটা শকুন বোধ হয় ডানা নাড়িতেছে, তাহারই শব্দ মাঝে মাঝে কানে আসে। দিকচক্ররেখা, চিত্ত যে জায়গায় বসিয়াছে, সেখান হইতে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যায়, পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশ, দীর্ঘ, সোজা উজ্জ্বল আলোর রেখার সমষ্টি।
চিত্ত যেন অতি সন্তর্পণে কী লক্ষ করিতেছেঃ তাহার মনে হাস্যমুখী এক মেয়ে ছায়া ফেলিয়াছে। সিঁথি বিহীন চুল টান করিয়া বাঁধা, চোখ দুটিতে হাসি ঝরিয়া পড়ে, ঈষদুন্মুক্ত ঠোঁটে কত কথা যেন থামিয়া আছে।
ললিতা যেন আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহার চোখের সামনে। হাত বাড়াইয়া চিত্ত তাহাকে ধরিতে গেল কিন্তু সে তাহার হাত সরাইয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে ঘরে দৌড় দিল। যেন বিদ্যুৎ।
চিত্ত তাহার পিছনে পিছনে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়া দেখিল, ললিতা মুখে হাত চাপিয়া ঘরের এককোণে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
সে কাছে গিয়া তাহার কাঁধে দুই হাত রাখিল।
বলিল, হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছো যে!
হাত দুইটি সরাইয়া দিতেই ললিতা আবার ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
চিত্ত নত হইয়া বলিল, ঠোঁট ছুয়ে থামাব নাকি হাসি?
ললিতা যেন একটা অবলম্বনের মতো তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল।
একটু পরে চিত্ত বলিল, ওগো ললিতে আজও তোমার কাছে একটা পান চাইছি!
—এই ভর সন্ধ্যেবেলা, এখন কতো কাজ! ললিতা বলিল,-আলো জ্বালাতে হবে না?
তাহার হাত ধরিয়া সে বাহিরে আসিল।
এখনও একটু আলো আছে, সব অস্পষ্ট দেখা যায়। এমন সময় তাহারা দেখিল, ঠকঠক শব্দ করিয়া খড়ম পায়ে রতন এদিকে আসিতেছে।
চিত্ত চলিয়া যাইতেছিল কিন্তু সে ডাক দিয়া বলিল,-কোথায় যাচ্ছ গো, আমি যে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার সঙ্গে কদিন ধরে ভালো করে কথা বলতেই পারছি না। এসো, বসো।
রতনও বসিল। বলিল, ললিতে এখনও আলো জ্বালাওনি, কখন জ্বালাবে বল? তোমাদের কী সে দিকে হুশ আছে।
সে চিত্তর দিকে একবার চাহিল।
চিত্ত অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রাখিল।
তালপাতায় ডানার ঝাপট। চিত্ত স্বপ্ন হইতে চমকিয়া উঠিল, দেখিল : অন্তদৃষ্টির সীমানায় ললিতা অদৃশ্য হইয়া গেছে, আর কিছুই নাই, ধু ধু করে শূন্য মরুভূমি।
সূর্য অস্ত গেছে। সে বঁড়শি গুটাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। পথে আসিয়া পাশের ঝোপে ছিপটা রাখিয়া সে রতনের ওখানে চলিল।
ঘরের বাহিরে কেহ নাই। চিত্ত চারিদিকে চাহিল, কাহাকেও দেখা যায় না। আখড়ার পূর্বদিকে মেহেদি গাছের বেড়া ঘেরা একটি ছোটো বাগান আছে। চিত্ত সেখানে গিয়া দেখিল, সাজি হাতে ললিতা ফুল তুলিতেছে। সে তাহাকে লক্ষ করে নাই।
কাছে গিয়া চিত্ত ডাকিল, ললিতে। ললিতা চকিতে তাহার পানে চাহিয়া হাসিল।
-ফুল তুলছ?
–হুঁ। দাঁড়াও, হয়ে গেছে প্রায়।
চিত্ত বলিল, ইস, এত ফুল দিয়ে কী করবে? আমাকে একটা দাও না, ওই যে গোলাপ ফুলটা—
তুমি নেবে? ললিতা খুশি হইয়া ফুলটি ছিঁড়িয়া আনিয়া দিল।
চিত্ত বলিল, আর সব কোথায়?
–মাধবদির মেলায় গেছে।
–গোঁসাইও?
–না। তিনি ওদিকে এইমাত্র কোথায় যেন গেলেন।
ললিতা বাগান হইতে বাহির হইয়া ঘরে ফুল রাখিয়া আসিল। চিত্ত আঙিনায় একটা সিঁড়ির উপর বসিয়া পড়িয়াছে।
ললিতা কতটুকু পুরোনো কাপড় আনিয়া সলিতা পাকাইতে বসিল।
চিত্ত বসিল, তোমার কথা মনে হতেই চলে এলাম। ভেবেছিলাম আসব না।
ললিতা হাসিয়া বলিল, আমি তাহলে ভাগ্যবতী।
চিত্ত বলিল, গোঁসাইর মনে আমার উপর রাগ জমে উঠেছে। আমি লক্ষ করেছি। তোমার কী কোনো অসুবিধে হচ্ছে সে জন্যে?
-একটুও না।
-তাই! সে তোক ভালো আমি জানি, কিন্তু পৃথিবীতে এমন কতগুলো ব্যাপার আছে যাতে ভালো থাকা যায় না। ওকে আমার ভালো লাগে, বিশ্বাস করো ওর ওপর আমার এতটুকু রাগ নেই! যদি উপায় থাকত তবে ঠিক আগে যেমনটি ছিল তেমনটি হওয়া যেত।
নতমুখী ললিতা সলিতা পাকাইতেছিল।
চিত্ত বলিল, কিন্তু উপায় যে নেই। সেই কবে ছিল যাওয়ার কথা, এখনও যাইনি কেন জানো?
-জানি গো জানি।
—কী জানো?
ললিতা হাসিয়া বলিল, বলতে পারব না!
চিত্ত বলিল, প্রথম যে দিন তোমাকে দেখি, সে দিনে তুমি যে গানটি গেয়েছিলে তার রেশ এখনও আমার মনের অনেক উঁচু পর্দায় উঠে বাজছে, আমার খুব ভাল লাগছে। ললিতে—