চিত্ত বলিল, কে বলে আমি খিদের জ্বালা ভুলেছি? তার জ্বালায় একেবারে জর্জরিত। তাই তো বলছিলাম প্রসাদ দিতে। দাও, দাও, ওগো ললিতে
ললিতা হাসিয়া ফেলিল, মাছরাঙা দেখেছো?
—দেখেছি।
–সেগুলোকে আমার ভালো লাগে না।
—কেন?
–তা ঠিক বলতে পারব না, কী জানি কেন!
–ও, চিত্ত বলিল, আচ্ছা চাতক দেখেছো?
–দেখেছি।
—ওই পাখিটা আমার দু-চোখের বিষ।
–কেন?
চিত্ত বলিল, কেমন হাঁ করে বৃষ্টির আশায় চেয়ে থাকে ভিক্ষুকের মতো, ভয়ানক অলস, সবই আরামে পেতে চায়। আর পেটভরা অহংকার।
ললিতা আবার হাসিয়া উঠিল, দুষ্ট!
চিত্ত বলিল, কেমন, হয়েছে তো? আমারও মুখ আছে।
-আরও বলবে?
–বলব না? বলবই তো!
চিত্ত চুপ করিয়া রহিল।
কতক্ষণ ব্যস্তভাবে এটা ওটা নাড়িয়া আড়চোখে ললিতা চাহিয়া দেখিল, একটু পরে মুখ ফিরাইয়া বলিল, রাগ করেছ?
–না, চিত্ত হাসিয়া ফেলিল।
ললিতা সহজ হইয়া বলিল, আমি তো কোনো কাজই করতে পারছিনে। তোমার সঙ্গে কেবল গল্প করছি। কখন একটা অঘটন ঘটে, হাত পুড়ে যায়, কে জানে?
চিত্ত বলিল, তা কখনো পুড়বে না, আর যদি পোড়েই তখন কি করব জানো?
জানি?
—কি জানো বলো।
ললিতা তবু চুপ।
–বলো।
—তোমার ওই কালো চোখ চেপে ধরবে আমার ব্যথায়।
–তারপর?
—তারপর চোখ থেকে বেরিয়ে আসবে জল, মুছে দেবে আমার ব্যথা, আমার মন তখন খুশিতে ভরে উঠবে।
আনন্দে চিত্ত তাহার হাত বাড়াইয়া দিল।
কিন্তু ললিতা চকিতে আর একপাশে সরিয়া হাসিমুখে অর্ধেক সুর মিশাইয়া গাহিল : বঁধু ছুঁতে করেছি মানা–
-ওগো ললিতে, ডালনা হয়েছে? বিনোদিনী আসিয়া উপস্থিত হইল।
চিত্ত একটু দাঁড়াইয়া চলিয়া আসিল। আর একদিন দুপুরবেলা আঙিনায় বসিয়া ললিতা একটা আসন তৈরি করিতেছিল। আখড়ার প্রায় সবাই ঘুমাইয়াছে, কাহাকেও দেখা যায় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। অলস, মন্থর গতিতে সময় চলে।
বাতাস একটুও নাই।
ললিতা একমনে রঙিন সুতায় ফুল তুলিতেছিল; গলায় গানের একটা কলি। কাছেই অপ্রশস্ত পথে শুকনো পাতায় মর্মর উঠিল, কে যেন যাইতেছে। সে মুখ তুলিয়া দেখিল, চিত্ত। সে খুশি হইয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িল। চিত্তর একবার এদিকে চোখ পড়িয়াছিল। সে কাছে আসিয়া বলিল, একা কী করছ? গোঁসাই কোথায়?
–ঘুমুচ্ছেন।
চিত্ত বলিল, এক গ্লাস জল খাওয়াবে?
–আবার সেই জল, ললিতা হাসিয়া কোল হইতে আসন রাখিয়া উঠিল। জল খাইয়া চিত্ত বলিল, একটা পান? ললিতা পান আনিয়া দিল। চিত্ত সেটা মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে বলিল, কী সেই গানটা সেই যে ভজহরি গাইত।—অর্থটা বেশ মনে আছে।
কী অর্থ, গানটা কে যে গাহিত তাহা হঠাৎ ঠিক করতে না পারিয়া ললিতা জিজ্ঞাসা করিল।
অর্থটা হচ্ছে, তোমারই দেওয়া পানে রাঙিয়া ঠোঁট ছাপ এঁকে দেব তোমার সাদা ঠোঁটে। চিত্ত তাহার পানে চাহিয়া নীরবে হাসিতে লাগিল।
ললিতার মুখ রাঙা হইয়া উঠিল, সে তাড়াতাড়ি আসনটা হাতে লইয়া বলিল, একটা কাজ করবে?
বল?
–এখানে আমার নামটা লিখে দাও না, আমি তুলব।
চিত্ত হাসিয়া বলিল, কী দিয়ে লিখব?
—দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।
চিত্ত সযত্নে নাম লিখিয়া দিল।
কতোক্ষণ চুপচাপ।
সে বলল, তোমার সেই গল্পটা তারপর কী হল!
–সেই যে ছায়া দেখে জলভরা আর হচ্ছে না?
–হ্যাঁ।
—তারপর কততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম হুঁশ নেই, একটা ডাকে হঠাৎ চমকে উঠে দেখি সন্ধ্যার বাকি নেই, পুকুরে ছায়া নেমেছে, জলের রঙ হয়ে গেছে কালো, বাতাস হয়েছে স্থির। কী আর করি, কলসিতে জল ভরে ছায়া ভেঙে রাগ করে চলে এলাম। রাগ আর কারুর ওপর নয়, নিজের ওপর! আমি কী পাগল হয়েছি! কিন্তু কে জানত তখন, একরকম মানুষ আছে, নিজের থেকে পরের ওপর মায়া তাদের বেশি, নিজের চেয়ে পরের সম্বন্ধে তারা বেশি সচেতন? লম্বাপানা লোকটা, চমৎকার চেহারা। এত কথা বলতে পারি কিন্তু সেদিন কী হল মুখে কিছুই এল না। এমন নাকি হয়। এর মূলে নাকি আর কিছুই নয়, শুধু ভালো লাগা! যাই হোক তাড়াতাড়ি চলে এলাম এই ভেবে, লোকটি হারিয়ে যাবার নয়। আমার অতি কাছেই সে সারাক্ষণ থাকে।—পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চিত্তর দিকে একবার চাহিয়া ললিতা হাসিয়া ফেলিল। চিত্ত তাহার একটি হাত ধরিয়া বলিল, আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে, আমাকে পেছনে রেখে মেয়েটি চলে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে আমার দৃষ্টিপথ থেকে, কিন্তু মনের পর্দায় আরও উঠছে জেগে, আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।-ওগো ললিতে।
-কী গো!
চিত্ত তাহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া চুপ করিয়া রহিল, অনুভব করিল তাহার হাতের উষ্ণতা। একটু হাসিয়া ললিতা তাহার হাত ছাড়াইয়া লইল। একটু পরে আবার ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
—হাসছ যে?
—ভাবছি আজ কতো কথাই না বললাম। এক একটা দিন এমনি হয়, না?
—হ্যাঁ।
-নইলে কে জানতো, তুমি আসবে এখন? ললিতা আবার হাসিল। তাহাকে যেন একটা রোগে পাইয়া বসিয়াছে। কিন্তু চিত্ত ইহাই চায়। হাসিলে এত সুন্দর দেখা যায়, সে আগে কখনো এরকম দেখে নাই। সে বলিল, আসনটা কার জন্যে করছ?
-যে বসবে তারই জন্যে।–গোঁসাই?
-আজ তবু একটু ঘুমিয়ে নিলুম, দুজনকেই ভয়ানক আশ্চর্য করিয়া রতন দেখা দিল, বলিল, দুপুরবেলা কখনো আমার ঘুমের অভ্যাস নেই, আজ কী জানি কেন হল! চিত্ত কখন এলে, আরও আগে?
চিত্ত কিছু বলিল না।
রতন দুজনের দিকেই একবার করিয়া চাহিয়া বলিল, ললিতা ভারী কাজের মেয়ে, এদিক দিয়ে অমন যে বিনু ঠাকুরণ তাকেও হার মানায়। কী ললিতে, বসবার একটা কিছু দাও?