চিত্ত বিস্ময়ে বলিল, তুমি দ্যাখোনি?
-না, শুনলাম। খুব ভিড় হয়ে গেছে সেখানে।
—আমি যাই, চিত্ত উঠিয়া বলিল, কোনখানে, খেয়াঘাটে তো?
—হ্যাঁ। চিত্ত চলিয়া গেল।
ললিতা এতক্ষণ একটি কথাও বলে নাই, আশ্চর্য হইয়া সব শুনিতেছিল, এখন। মুখ নীচু করিয়া কী যেন ভাবিতে লাগিল।
রতন বলিল, তোমার কী মনে হয় ললিতে, আত্মহত্যা?
—হ্যাঁ।
হাটের একটানা সোরগোল। বেলা গড়াইয়া যাইতেছে, বিকাল হইতে বেলা বাকি নাই।
সকলেই মড়াটি দেখিয়া আসিয়াছে, আবরণহীন বিপুল দেহ, ফুলিয়া পচিয়া একটি বিশ্রী গন্ধে সেখানের বাতাস ভরপুর।
ললিতা ঠিকই বলিয়াছে, জানা গেছে, মেয়েটি আত্মহত্যাই করিয়াছিল। গাঁয়ের মধ্যে এমন একটা ঘটনা অভিনব বটে। আলোচনার আর শেষ নাই। রতনের ওখানেও জমিয়া উঠিয়াছে।
রাত্রি দশটা হইবে। সকলেই কিছু না কিছু বলিয়াছিল। চুপ করিয়াছিল কেবল ললিতা। সে ঘরের ভিতর বসিয়াছিল। বৈঠক হইতে নিঃশব্দে চিত্ত উঠিয়া গেল। আজ এতক্ষণে মাত্র চাঁদ উঠিয়াছে। বনানী কথা বলিতে শুরু করিয়াছে। পায়ে হাঁটা সাদা পথ টুকরা জ্যোৎস্নায় মনোরম। সৌন্দর্য আহরণের নেশায় চোখ বুজিয়া আসে, পা ফেলা মন্থর, দেহ শিথিল। কিন্তু বুকে হাত রাখিয়া সে হাঁটিতে লাগিল। পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্রের উৎস উপভোগে বঞ্চিত এক অনাগত আত্মা জ্যোৎস্নালোকিত শুকনো বালুচরে নিঃশ্বাস না ফেলিয়া ঘুমাইতেছে।
বহিরাবরণ তাহার মা, নিজের মূঢ়তায় অন্যকে মারিবার বেদনায় এখনও বোধকরি তাহার চোখের জল শুকায় নাই।
সেখানে মড়াকে ঘিরিয়া লোক জমিয়াছিল অনেক, নানা জনে নানা কুৎসিত মন্তব্য করিয়াছিল, ওদিকে ললিতাও ঠিক এই কথাই ভাবিতেছিল। কিন্তু আর একটা জিনিস যাহা তাহার মনের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিল তাহা হইল ভয়।
ইস, কী ফুলিয়াছে রে বাপু। কী বিকৃত মুখের ভঙ্গি, কেমন বিশ্রী গন্ধ। ললিতা শিহরিয়া উঠিল।
আচ্ছা এইমাত্র ভাঙিয়াছে। রতন একা কতক্ষণ বসিয়া, উঠিয়া ঘরে গেল। একপাশে কাঁপিয়া কাঁপিয়া তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছে। সেই আলোয় দেখা গেল, ঘরের এককোণে মাটির উপরেই ললিতা পড়িয়া ঘুমাইতেছেঃ শরীর কুঁচকানো, মাথায় একটি, আর এক হাত বুকের উপর ন্যস্ত।
রতন কিছুক্ষণ তেমনি নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর কাছে গিয়া ডাকিল, ললিতে। কোনো উত্তর আসিল না।
-ওগো ললিতে, ললিতে।
—কে? ললিতা জাগিয়া উঠিল।
—এই তো আমি! হঠাৎ সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়িয়া যাওয়ায় সে ভয়ে সংকুচিত হইয়া বসিয়া রহিল। মুখে কোনো শব্দ নাই, আলোর দিকে স্থির দৃষ্টি। রতন বলিল, একেবারে খালি যে, ওরা সব কোথায় গো?
-দক্ষিণের ঘরে বোধ হয়।
–কিন্তু তুমি এখানে একা কেন? রতনের চোখ নিবিড় হইয়া উঠিল, বলিল, না খেয়ে দেয়ে এখনই ঘুমুচ্ছো!
—টেরও পাইনি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ললিতা দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল, ওদের ডাক দেব?
—না।
—তবে কি? ললিতা তাহার দিকে কতোক্ষণ চাহিয়া কী মনে করিয়া আঙিনায় গেল, কাহাকে যেন খুঁজিল, তারপর বাঁশের খুঁটি চাপিয়া নিঃশব্দে বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। এখন মাথার উপরে চাঁদ, জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করে উঠানটি, গাছের নীচে সেই ভাঙা নরম আলো। পৃথিবী ভরিয়া রূপের প্রবাহ বহিয়া গেছে, সে দিকে চাহিয়া চক্ষু বুজিয়া আসে, বুকে নিঃশ্বাস ভরিয়া ওঠে।
কিন্তু বাহিরের পৃথিবীর তুলনায় মনের কোণ শূন্য, কেবল শূন্য। সেই মরুভূমিতে কাহার হাতের স্পর্শ, ওই জ্যোৎস্নার মতো নরম, বুলাইয়া গেছে। কিন্তু কী জানি কেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। যেন বিশুর সেই আগ্রহের মূলে শ্মশানবাসী খেয়ালই বেশি।
পিছনে দরজার চৌকাঠ ধরিয়া রতন চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ললিতা দেখে নাই, টের পাইলে সে হয়তো ভীষণ চমকিয়া উঠিত।
পর দিন ভরা দুপুর মাথায় করিয়া চিত্ত আসিল জল খাইতে। অন্তত তাহার কথায় এই বোঝা যায়। ললিতা তখন রাঁধিতেছিল, হাসিয়া বলিল, কেন গো এমন অসময়ে?
খুঁটি ধরিয়া চিত্ত বলিল, তেষ্টা পেয়েছে।
বিস্ময়ে ললিতার চোখ বড়ো হইল : তা বলে অতদূর থেকে এলে? বাড়িতে জল নেই? আচ্ছা এ কী রকম তেষ্টা?
-আরে বাপরে; সে ভয়ানক তেষ্টা, ছাতি ফেটে যাচ্ছে, পেট চোঁ চোঁ করছে, বুক শুকিয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না, এ কী, দাঁড়াতেও তো পারছি না গো। চিত্ত বসিয়া পড়িল।
তাহার ভঙ্গি দেখিয়া রুদ্ধ হাসিতে ললিতার ফর্সা মুখ যেন ফাটিয়া পড়িতেছিল। চিত্তর জলের তৃষ্ণা সত্যি পাইয়াছিল কি না জানা যায় নাই কিন্তু সে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল; কপালে আর তীক্ষ্ণ চিবুকে অল্প ঘাম, ঠোঁটে হাসি, কপালে আর গালের পাশে কিছু শুকনো বিপর্যস্ত চুল।
ললিতা হাত ধুইয়া জল আনিয়া দিল। চিত্ত অল্প একটু খাইয়া গ্লাসটি এক পাশে রাখিয়া বলিল, আজ প্রসাদ দেবে? তোমার রান্নার নাকি তুলনা নেই?
-কে বলে?
—সকলের মুখে তাই শুনি, বিশেষ গোঁসাই তো প্রায়ই বলেন।
—গোসাইজি? ললিতা মুচকি হাসিল।
–হাসলে কেন?
–এমনি।
কোনো কারণ না থাকলে এমনি কেউ হাসে?
ললিতা চুপ করিয়া রহিল।
চিত্ত বলিল, বললে না?
—এমনি গো এমনি, ললিতা হাসিয়া অন্য কথা পাড়িল; —খাওয়া হয়েছে?
-তা তো মনে নেই।
–খেলে কী না খেলে তাও মনে নেই, হা ভগবান! খিদের ব্যাপারে মানুষ কী করে ভুলে যায়? তুমি কী করে ভুললে?