চিত্ত রতনের ওখানে গেল।
-কী করছ গোঁসাই?
—এই তো এইমাত্র চান করে দুটি খেয়ে নিলাম।
—এসো। ওগো ললিতে, সতরঞ্চি পেতে দাও তো।
ললিতা শতরঞ্চি হাতে আসিয়াছিল, কিন্তু চিত্ত তাহার হাত হইতে সেটা লইয়া বলিল, থাক থাক বোবা মেয়ে।
চিত্ত খুব আস্তেই বলিয়াছিল।
লজ্জায় রাঙা হইয়া ললিতা বলিল, বারে।
আনত মুখের চাপা হাসির ভঙ্গিটি বেশ সুন্দর।
রতনের চোখে কিছুই এড়ায় না, সে বলিল, কি বলে গো?
ললিতা ঘরে যাইতে যাইতে একবার চিত্তর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমি নাকি বোবা। এমন মিথ্যে বলতে যে পারে, সে কী না করতে পারে!
-–মানুষকে মেরে ফেলতে পারে?
–হ্যাঁ।
রতন একমুখ হাসিয়া উঠিল,—শুনছ চিত্ত, কী বলছে?
—শুনেছি। চিত্তও হাসিতে লাগিল। একটু পরে রতন বলিল, হাট জমেছে কেমন?
–ভালো।
—আগে দেখেছি, এত লোক হত না। এখন একটা বাজার চলতে পারে কী বল?
—না। চিত্ত অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল। তার এই অন্যমনস্কতার কারণ রতন বোঝে। সে ডাকিল,-ওলো ললিতে, কোথায় গেলে?
-বলুন। ললিতা আসিল।
রতন বলিল, আজ ললিতা যা বেঁধেছিল—বিনু ঠাকরুন কোথায়?
-ঘুমুচ্ছেন ও ঘরে।
–কী বলছিলাম, হ্যাঁ যা বেঁধেছিল, এক কথায় চমৎকার। অনেকদিন এমন রান্না খাইনি।
চিত্ত ললিতার দিকে চাহিয়া বলিল, তা এমন রাঁধলে কার লাভ? ভাগ তো পাইনি। এখন শুনেই পেট ভরাই আর কী!
ললিতা একপাশে গুটিসুটি হইয়া বসিল।
রতন বলিল, অবিশ্যি একদিন যা হয়েছিল সে কথা মনে হলে এখনও হাসি পায়। আমরা না হয় ঘরের মানুষ, কিছু মনে করব না, কিন্তু সেদিন দু-চারজন অতিথি খাওয়াতে হলে কী ব্যাপারটা হত বল দেখি?
—সে তো আর ইচ্ছে করে করিনি, ভুল হয়ে গিয়েছিল।
—তা বটে, কিন্তু বিনু ঠাকরুণ সেদিন থেকে সত্যি তোমার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন। আজ আবার কী মতিগতি হল, রাঁধতে দিলেন। সৌভাগ্য তোমার, তুমি সে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে না, পাস হলে, আরে বৈকুণ্ঠ যে!
একটি মাঝবয়সি লোক পথ দিয়া যাইতেছিল। গোঁসাই-এর ডাকে থামিল।
—তোমরা একটু বসো, আমি আসছি! রতন লোকটির কাছে গিয়া কী কথা বলিতে বলিতে পথের বাঁকে অদৃশ্য হইল।
ললিতা চুপ করিয়া বসিয়াছিল। এবার চিত্তর দিকে মুখ তুলিয়া হাসিল। চিত্তও হাসিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি বাইরে গেলে অতবড় ঘোমটা দাও কেন?
-এমনি!
–পাছে আমরা দেখে ফেলি, না!
–দূৎ, তার জন্য নয়। সে বালাই কার থাকে? যার— ললিতা মাঝখানে থামিয়া গেল। চোখের দৃষ্টি করুণ।
চিত্ত সেদিকে কান না দিয়া বলিল, হ্যাঁ খুব বুঝি রূপ না? খুব সুন্দরী?
ললিতা মুচকি হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ খুব সুন্দরী। পুকুরে জল আনতে গিয়ে জলে যখন ছায়া পড়ে, প্রথমে ভয়ানক কাঁপতে থাকে, ছায়াগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তারপরে একটু পরে ভাঙা ছায়া জোড়া লাগে, আশ্চর্য হয়ে দেখি, সে কী অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে কলসি কাঁখে করে দাঁড়িয়ে আছে, আমার দিকে চেয়ে হাসছে। জলকে নেড়ে দিতে ভয় করে, তাহলে ঢেউ হবে, আর মেয়েটি হারিয়ে যাবে। আমার জল ভরা আর হয় না। শেওলাভরা সিঁড়ির উপর বসে পড়ি। আর চেয়ে থাকি–ললিতা আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
-ইস, এত অহঙ্কার। তারপর আর আছে?
ললিতা বলিল, নিশ্চয়ই আছে। সে আর একদিন বলব। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া চিত্ত বলিল, সেদিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে গান গাইলে, চমৎকার গান, সেই থেকে তোমায় আমি চিনি। কতো বছর এখানে এসেছ?
-কতো বছর আবার? বারোটা মাসও তো হয়নি গো। যেদিন প্রথম এলাম, তখন খুব ছোটো ছিলাম।
–নাকি?
—আর এখন কতো বড়ো হয়ে গেছি, অনেক বড়ো।
—এক বছর না যেতেই?
—হ্যাঁ। ললিতা নীরবে হাসিল।
চিত্ত বলিল, আচ্ছা, এমন চমৎকার গলা পেলে কোথায়
–তার এক কাহিনি আছে।
—সবটার পেছনেই ইতিহাস? কী সে ইতিহাস শুনি?
ললিতা বলিল, সকলেই অনুযোগ করত, সবই যখন আছে, গলার সুর নেই কেন? আমিও ভাবলাম সত্যি তো, কিছুরই তো অভাব নেই, তবে গলায় গান নেই কেন? ঠিক এই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াতে লাগল আমার মনে, বোধ হয় দিনরাত। ইচ্ছে যদি তেমন হয়, উপায় একটা তার হয়ই। আমারও হল। রাতের স্বপ্ন বন্দিনী হল হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেই গানের সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্নও এল, যার জন্যে সারা জীবন চোখের জল ফেলেও সান্ত্বনা মেলা ভার।
—সেটা কী?
–তা অন্যদিন বলব।
চিত্ত হাসিয়া ফেলিল, তোমার কোনো শেষই কী আজকে শেষ হবে না? ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখছ কেন?
—তাতো আমি নিজেই কিছুই জানিনে।
বোধহয় তোমার ওটা স্বভাব।
–স্বভাব?
–হ্যাঁ। এক একজনের এক একটি স্বভাব থাকে, যা নিতান্ত নিজের, যা অন্য কারুর সঙ্গে মেলে না। যেমন ধরো আমার স্বভাব, রোজ এখানে আসা—
-কেন? ললিতা মুচকি হাসিয়া বলিল।
চিত্ত কী যেন বলিতে যাইতেছিল এমন সময় রতন দেখা দিল, নিজের পরিত্যক্ত আসনে আবার বসিয়া বলিল, এক কান্ড ঘটেছে।
ললিতা উৎসুক চোখে তাহার দিকে চাহিল। চিত্ত জিজ্ঞাসা করিল, কী?
কোনো ভালো খবরেই রতন বশীভূত নয়, অন্তত বর্ণনার দিক দিয়া। বেশি হৈ চৈ করা তাহার স্বভাব বিরুদ্ধ।
রতন বলিল, নদীর ঘাটে একটা মড়া এসে লেগেছে।
–মড়া!
–হ্যাঁ! মড়া একটি মেয়ে, জলে থেকে ফুলে নাকি ভয়ানক দেখতে হয়েছে। তার ওপর পেটে আবার নাকি একটা সন্তান। আত্মহত্যা না সাপের কামড়ে মরেছে। কে জানে?