রতন কোনো উত্তর না দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। চোখের দৃষ্টি নিবিড় হইয়া আসিয়াছে। কখন বিকাল হইয়াছে। গাছপালার পাশে তির্যক ছায়া, তার ফাঁকে ভাঙা মিষ্টি রোদ।
রতন আগের কথা আর না তুলিয়া অন্য লোকটিকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, তারপর কালিচরণ, কেমন আছ?
-এই তুমি যেরকম রাখ। কালিচরণ হাসিল।
—আমি রাখব কী হে? রাখবে একমাত্র আকাশের ওই—
রতন উপরের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ আবার বলিল, তোমার ছেলেটির না অসুখ করেছিল বলেছিলে?
–সেরে গেছে।
রতন এবার হাসিয়া বলিল, কালিচরণ, এ তোমার ভারী অন্যায়-বিয়ে করেছ সেই কবে, খাওয়ালে না, থাক, সে কথা নয় জোর করে ভুলেই গেলাম। কিন্তু তারপর ছেলে হল, তাতেও খাওয়ানোর নামটি নেই, এ কেমন কথা বল? ভারী অন্যায় ভারী—
কালিচরণ মুখ নীচু করিয়া হাসিল।
ঘরের ভিতর ছিল বিনোদিনী। তাহার গলা শোনা গেল–
-আর সে কথা মানুষের কাছে বলতে উলটে আমাদেরই লজ্জা করে। ওর সঙ্গে আমাদের এত ঘনিষ্ঠতা, আর তার মধ্যে কিনা বিয়ে হল, এমনকি ছেলে হল, তাতেও খাওয়ালে না! বাস্তবিক এসব কথা মনে হলে সংসার আর ভালো লাগে না।
রতন হাসি মুখে বলিল, ওরে বাসরে এতই দুঃখ।
-হ্যাঁগো। বিনোদিনী হাসিয়া উঠিল।
কালিচরণ লজ্জা পাইয়া বলিল, আচ্ছা, সে হবে-খন। ঝুলন পুর্ণিমা কবে?
-এখনও দু-মাস বাকি।
—সেদিন এখানকার উৎসবে যা খরচ হবে সব আমার।
রতন খুশি হইয়া বলিল, শুনছ ঠাকুরন?
—হুঁ।
কিছুক্ষণ পরে কালিচরণ চলিয়া গেল।
চিত্ত বলিল, কেন গাও না বলবে?
রতন চারিদিকে চাহিয়া মুখ বাড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল—বলি শোন। সে অনেক দিনের কথা। তখন আমাদের এখানে রাধা বলে একটি মেয়ে ছিল ওর একবার অসুখ হল, সে ভয়ানক অসুখ, মেয়েদের যেসব কঠিন রোগ হয়। কবরেজ চিকিৎসা করত। এতে হল না দেখে দু-কোশ দূরের মাধবদি, সেই যে যেখানে খুব বড়ো রথের মেলা বসে, সেখান থেকে মহিম ডাক্তারকে আনানো হল, সে বুড়ো এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু যার আয়ু সত্যি ফুরিয়ে এসেছে তাকে কী আর বাঁচানো যায়? যায় না। অবস্থা খারাপ হয়ে এল। এমন সময় হল কী, আশ্চর্য রাধা আমার গান শুনতে চাইল। কিন্তু ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর নীতি মেলে না। তখন এমনি খারাপ অবস্থা যে একটু টুঁ শব্দ করাও ভালো নয়। তা ছাড়া রোগীর মনে মরবার ভাব জেগেছে, প্রশ্রয় দেয়াও ভালো নয়। ক্ষান্ত হলাম। কিন্তু সে সময় যে অবস্থা, যে কাতরতা দেখেছি, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত গান গাওয়া হয়নি, হবেও না।
শুনিয়া চিত্তর কষ্ট হইল, কিন্তু কথাগুলি আস্তে আস্তে বলার সপক্ষে সে কোনো কারণই খুঁজিয়া পাইল না।
রতন নীচের দিকে চাহিয়া কী ভাবিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে সন্ধ্যা নামিয়া আসিল। আকাশে ধূসরতা, ছায়ার সঙ্গে বাতাস মিলিয়া যেন ভারী হইয়া গেছে। বনপথ স্তব্ধ।
চিত্তর দুটি চোখ কাহাকে যেন এতক্ষণ খুঁজিয়া ফিরিতেছিল, পায় নাই। সে হঠাৎ উঠিয়া বলিল, যাই এখন।
–এখনই যাবে?
–হ্যাঁ একটু কাজ আছে।
–রাতে আসবে?
—আজ ঠিক বলতে পারিনে, দেখি যদি পারি–
চিত্ত চলিয়া আসিল। ধূলা উড়াইয়া রাখাল ছেলেগুলি গোরু লইয়া ফিরিতেছে। কুকুরগুলি পথে আসিয়া দাঁড়ায়, আর অনর্থক ঘেউ ঘেউ করে।
সে আনমনে ধীরে ধীরে হাঁটিতেছিল। পথের পাশে সরকার বাড়ির খোলা পুকুর, জলে ভরা।
হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল এক কলসি জল কাঁখে ললিতার মতোই কে যেন সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া উঠিতেছে। চিত্ত আর একটু কাছে গিয়া ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিল, হ্যাঁ, সেই। বুকটা তাহার কেমন যেন করিয়া উঠিল।
তাহাকেই সে খুঁজিয়াছিল। চিত্ত যে পথের উপর দাঁড়াইয়াছে, ললিতাকে সেখান দিয়াই যাইতে হইবে। সে ধীরে ধীরে আসিয়া কাছ দিয়াই যাইতেছিল, চিত্ত বলিল, এই সন্ধ্যে বেলায় জল নিচ্ছ যে?
ললিতা নীরবে একটু হাসল। ভারী সুন্দর, চোখ দুটি ছোটো হইয়া আসে, লালাভ গালে টোল পড়ে, চামড়ার টানে চিবুকটি সরল হইয়া যায়।
চিত্ত বলিল, বারে, যোবা নাকি?
–না গো না। বোবা কেন হতে যাব। ললিতা আবার হাসিয়া সামনে অগ্রসর হইল।
দেখা যায়, সচকিত কতটুকু ফর্সা নগ্ন-পা, মাথা-ভরা চুল, চলমান, জল ভারে বাঁকা দেহলতা। ছায়ার স্নিগ্ধতা ঘিরিয়া রহিয়াছে।
চিত্ত সেখানে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। পথের বাঁকে অদৃশ্য হইবার আগে ললিতা আর একবার ফিরিয়া চাহিয়াছে।
পরের দিন হাটবার। হাট আখড়ার পিছনেই। ভোর হইতে আরম্ভ করিয়া দুপুরবেলা দুইটার মধ্যে জমিয়া উঠিল। নানা গাঁয়ের লোকে গিজগিজ করে। আর ভয়ানক গোলমাল। বড়ো বড়ো কয়েকটি বটগাছ ডালপালা শিকড় গাড়িয়া সমস্ত জাগয়াটিকে ছায়াচ্ছন্ন করিয়াছে, বট গাছের গোড়ায় উঁচু করিয়া মাটি দিয়া বাঁধানো, সেখানে কেউ নামিতে পারে না। এখানকার লোকদের বিশ্বাস, উহার মধ্যে দেবতার অংশ আছে, তাই পূজা দেওয়া হয়। এই গাছের বয়স কেহ আন্দাজ করিতে পারে না, ছেলে বুড়ো সকলেই বলে যে, জন্মাবধি তাহারা ঠিক এমনই দেখিতেছে। চিত্ত অনেকক্ষণ অনির্দিষ্টভাবে ঘুরিয়া বেড়াইল, দেখিতে বেশ লাগে। গরিবরা, মজুররা আর অল্পবয়সি ছেলেগুলি সস্তা সিগারেট কিনিয়া খাইয়া বেড়াইতেছে। অলস জীবনের একটু উত্তেজনা যেন অনুভব করা যায়।