তক্তপোষের উপর একটা বই, আর ভাঁজ-করা একটা ইংরেজি পত্রিকা। আর ভাঙা চেয়ারের উপর গায়ের জামাটা।
শৈলেনের জামা? পদ্মা হাত দিয়া আস্তে একটু ধরিল, ধরিয়া দেখিল, কলারের নীচে বেশ ময়লা পড়িয়াছে, আর ঘামের গন্ধ। শৈলেন—দার জামা! নীচের পকেটে কতো কাগজপত্র, এত কাগজপত্র যে কীসের, তা কে জানে! বুক পকেটে একটা নোটবই, আর একটা ময়লা রুমাল, রুমালের মধ্যে একটা কিছু বাঁধা। পদ্মার বুকের ভিতর টিপটিপ করিতে লাগিল, কোনো রুমাল দেখিলেই তাহার বুকের ভিতর এমনি টিপটিপ করিতে থাকে, শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত দ্রুত বহিতে থাকে।
রুমালটার ভিতর কী আছে কে বলিতে পারে? পদ্মা বাহিরের দিকে একবার তাকাইয়া দেখিল। শৈলেন এখনো জল ঢালিতে আরম্ভ করে নাই, মাসিমার বাসন কোসন নাড়ার শব্দ শোনা যায়। রুমালটা তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিল পদ্মা, হাতটা কাঁপিতেছে! এ কী, নোট? পাঁচ টাকার নোট? পদ্মার বুকের ভিতর টিপ-টিপ আরও বাড়িয়া গেল, রক্তের চলাচল আরও দ্রুত হইল। মাসিমারা চমৎকার মানুষ, এমন ভালো মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। সমস্ত বাড়ির মধ্যে তাহারাই তাহাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।…কিন্তু পাঁচ টাকার নোট! পাঁচ পাঁচটা টাকা! এখন লইয়া গেলে কেই বা জানিতে পারিবে? সোজা কথা সে এখানে আসে নাই। তবু যদি সন্দেহ করে—তবে খুঁজে বার করো। খুঁজিয়া পাইলে তো চোর বলিবে? হাতে-হাতে ধরা না পড়িলে কেউ কখনো চোর হয় নাকি।… মাসিমা..সেদিনও গদাধরের বউর কাছে মাসিমাকে চাল ধার লইতে দেখিয়াছে সে, হয়তো এই পাঁচটি টাকাই প্রায় মাসখানেকের সম্বল। পদ্মার হাত কাঁপিতে লাগিল, সারা শরীরের ভিতর কেমন একটা ভ্যাপসা গরম লাগিতেছে। ইস, পাঁচ পাঁচটা টাকা এখুনি দিব্যি হাতের ভিতর গুজিয়া বা বুকে ফেলিয়া সোজা উপরে চলিয়া গেলে কে জানিতে পারে। কিন্তু শৈলেন…শৈলেনদা একদিন মাসিমাকে লক্ষ করিয়া বলিয়াছিল, সত্যি,পদ্মার চোখের মতো এমন দুটি চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি, মা? সেকথা মনে করিয়া একাট মধুর অস্থিরতায় পদ্মার সারা মুখ লাল হইয়া গেল, টানা চোখদুটি আরও টান হইয়া আসিল। নোটটা কোনো রকমে রুমালের ভিতর জড়াইয়া সেটা পকেটে পুঁজিয়া রাখিয়া পদ্মা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল, বারান্দা পার হইয়া নিজেদের ঘরে আসিয়া ধপাস করিয়া খালি তক্তপোষের উপর শুইয়া পড়িল।
তাহাকে এমনি শুইতে দেখিয়া তাহার মা অমনি খন খন করিয়া বাজিয়া উঠিল : দ্যাখো, হাত পা ছড়িয়ে দস্যির মতো কেমন শুয়ে পড়ল। বাঃ বাঃ লাজ বলে কোনো জিনিস যদি থাকে। কাজের মধ্যে তো কেবল শুয়ে থাকা আর সময় মতো এসে দুটি খাওয়া।
শিবনাথের জুতায় লোহা লাগানো তখনো শেষ হয় নাই, সে ঘাড় ফিরাইয়া একবার মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ওই তো এক ইসটাইল হয়েছে দেশে, ঘরের কাজ না শেখা, যেন ওসব কিছুই নয়! আরে বাপু দুদিন পরে যে এই ঘরের কাজই তোমায় করতে হবে।…
কিন্তু চুরি কী সর্বদাই করা যায়? পদ্মা শুইয়া শুইয়া পিট পিট করিয়া চাহিয়া দেখিল, শৈলেন এখনও স্নান করিতেছে। তাহার মুখের রঙের অনুপাতে গায়ের রঙ অনেক ফর্সা। সেই শরীরের খানিকটা এখান হইতেই দেখা যায়—চমৎকার পেশিবহুল, আর ফর্সা, চক চক করে, চুলগুলি জলে ভিজিয়া একেবারে মুখের উপর আসিয়া পড়িয়াছে, ফর্সা বলিষ্ঠ হাত দুটি যেন দুটি সাদা পাখির মতো অল্প একটু জায়গার মধ্যে উড়িয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু চুরি কী আর, বলা নাই— কওয়া-নাই সকল সময়েই করা যায়? আর লোকেও কী যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এত বোকা যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহাদের দোষ! আর থাকিলেও সেটা যদি দু-একদিনের মধ্যেই ফুরাইয়া যায়, তাহা হইলেও তাহার দোষ! পদ্মার মনটা আজ সত্যই খারাপ হইয়া গেল। অন্য কোনোদিন এরকম হয় না। মন যদি সত্যই খারাপ হইয়া থাকে, তখন তাহার ইচ্ছা হইল একটু কাঁদে। আর কাঁদিলে মনটা খুব খারাপ কি না, তা ঠিক বোঝা যাইত। কিন্তু কান্না তাহার কখনো পায় না, আজও চোখ দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। স্তূপীকৃত ছেঁড়া বিছানায় মুখ গুঁজিয়া সে পড়িয়া রহিল।
রাত্রিশেষ
লোকটিকে কী জানি কেন চিত্তর একটু ভালো লাগিয়াছে। রতন গোঁসাই-এর গায়ের বর্ণ শ্যাম, চামড়া মন হয় পালিশ করা সোনার চেয়েও মসৃণ, লম্বা, দেহ এবং ঈষৎ মোটা, মাথা ভরা একরাশ ঘাড় পর্যন্ত চুল, একটিও পাকা দেখা যায় না, বেশ করিয়া সযত্নে আঁচড়ানো, চোখ দুটি গোল হইলেও বেশ ভাসা ভাসা চকচক করে, মুখে সর্বদাই মিষ্টি হাসি। সেদিনও গল্প হইতেছিল।
রতন একটা আসনের উপর দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া, সামনেই চিত্ত ও আর একটি লোক।
চিত্ত জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে কখনও গান গাইতে শুনিনি তো?
রতন হাসিয়া বলিল, গান গাইলে তো শুনবে। কিন্তু এ গাঁয়ে যখন প্রথম আসি তখন এই গানের জন্যই আমাকে সবাই ভালবেসেছিল। এখন আর গাই না। আশ্চর্য বটে। যা এখন তুমি খুবই ভালবাসলে পরে হয়ত তাই কোনো কারণে ভুলে যেতে পার, এটা কী আশ্চর্য নয়?
কথার ভাবে মনে হয় তাহার মূলে কোনো ইতিহাস আছে।
চিত্ত বলিল, নিশ্চয়ই। কিন্তু তোমার এই গান না গাওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে বোধ হয়!