পদ্মার মা-র আজ দুপুরবেলা ঘুম হয় নাই। মেয়ের চেহারাখানা দেখিতে না দেখিতেই সে খনখন করিয়া বাজিয়া উঠিল, এই যে রানি এসেছেন দেখছি। এতক্ষণ হৈ-রৈ করে কোথায় বেরোনো হয়েছিল শুনি? পাড়া বেড়িয়ে এলেন বুঝি? এ ছাড়া আর কী কাজ? কাজের ঠেলায় খাওয়া-দাওয়া সারবার সময়ই বা কোথায়? মা হঠাৎ ঝাঁটার দিকে হাত বাড়াইয়া সামনের দিকে অগ্রসর হইল, নিজের কুঞ্চিত মুখখানা কংকালের মুখের মতো বিকৃত করিয়া বলিল, যা এখান থেকে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা বলছি।
ঘরের একপাশে আলোর কাছে বসিয়া শিবনাথ পুরোনো একজোড়া জুতায় লোহা মারিতেছিল। একবার পেছন ফিরিয়া চাহিয়াই সে বলিতে আরম্ভ করিল, আমি কিন্তু তোমাদের ওসব ইসটাইল-ফাইল ভালো বুঝিনে। এই যে যার তার সঙ্গে কথা কওয়া, যেখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়া—এ যেন এক ইসটাইল হয়েছে আজকাল! যতো সব…। খবরের কাগজে রোজই তো পড়ি, পড়তে পড়তে কান ঝালা পালা হয়ে গেল। এই তো সেদিনও শুনলাম অমূল্য চৌধুরীর বড়ো মেয়েটা বাড়ির সামান্য একটা তাই নিয়ে কত কেলেঙ্কারি! শিবনাথ নিজের মনে বিড় বিড় করিয়া আরও অনেক কিছু বলিল, তারপর এই বলিয়া উপসংহার করিল
—আমার কথা হল মেয়ে মোলোয় পড়ল তো অমনি বিয়ে দাও, বাস! লেখাপড়া দিয়ে কী হবে? বিয়ের ঘরে কোথায় থাকে লেখাপড়া, আর কোথায় থাকে গান। এই গান হয়েছে আর এক ইসটাইল দেশে। আমাদের নির্মলের বউ সেদিনও বলছিল— শিবনাথ দুরাত্মীয় ধনী ভাগ্নে নির্মল এবং তাহার স্ত্রীর কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিল।
মা তাহার মেয়ের দিক এতক্ষণ কটমট করিয়া—চাহিয়াই ছিল, এবার ঠিক তাহার সামনে গিয়া থপ করিয়া এমনভাবে খানিকটা থুথু ফেলিল যে মনে হয় যেন। তাহার গায়ের উপরেই ফেলিতেছে, তারপর চেঁচাইয়া বলিয়া উঠিল, বাঃ দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন করে দ্যাখো, যেন হুকুম আলী সরদার! দুনিয়ার কাউকে পরোয়া নেই! যা এখান থেকে, আমার সুমুখ থেকে চলে যা বলছি?
ব্যাপার দেখিয়া পদ্মার মুখের চেহারা এমন হইয়া গেল যে, মনে হয় যেন সে ভাবিতেছে, ইস, আজ তোমরা সবাই মিলে আমাকে এমন করে বকছো কেন?
ব্যাপারটা সে সহজেই বুঝিতে পারিল। হাতে পয়সা না থাকিলেই কী। তাহাকে সবাই মিলিয়া এমন বকাবকি করিবে? হাতে পয়সা না থাকাটাই যেন তাহার দোষ! সর্বদাই কী আর চুরি করা যায়? সেকালেই তো আর যাহাদের চুরি যায় তাহাদের মতো এমন বোকা নয় যে প্রায় চোখের উপর দেখিয়াও ধরিতে পারিবে না। তবুও চুরি করিতে হইবে। আর না করিলে মাঝে মাঝেই বলা-নাই কওয়া-নাই এমনি বকাবকি শুনিতে হইবে। পদ্মার মনটা আজ সত্যই একটু খারাপ হইয়া গেল। আর কোনোদিন এরকম হয় না। সে নিঃশব্দে সেখান হইতে সরিয়া। পড়িল।
বাড়িটা এখন একটু নির্জন। ছেলেমেয়েগুলি একেবারে সারাদিনের মতো রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িয়াছে কখন। সর্বাঙ্গে এক গাদা ধুলাবালি লইয়া সেই সন্ধ্যার সময় ফিরিবে, তারপর যে যার মতো বসিয়া খাইয়া দাইয়া বিছানায় পড়িয়া যাইবে। দুপুরবেলায় তাই বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম নির্জন বোধ হয়। ভাঙা বারান্দায় এখানে-সেখানে জল জমিয়া রহিয়াছে, এখনও শুকায় নাই, এমন স্যাঁতসোঁতে যে আর শুকাইবে না।
পাশ দিয়া একজন প্রৌঢ়া বিধবা ত্রস্ত পায়ে হাঁটিয়া যাইতেছিল। তাহার হাঁটিবার ভঙ্গিই এ রকম। তাহাকে দেখিয়া পদ্মা ডাকিল,-মাসিমা? মাসিমা যেন তাহার ডাকের জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, তার দিকে না চাহিয়া ফরফর করিয়া বলিল,–এতক্ষণে ছেলে আমার এসেছেন। তার যাওয়ার আয়োজন করতে হবে তো! —ছেলে? মাসিমার ছেলের নাম শৈলেন। সে অমনি প্রায়ই ভোর না হইতেই কোথায় বাহির হইয়া যায়, তারপর বেলা দুইটায় তিনটায় আসে। তারপর আবার সেই বিকাল না হইতেই বাহির হইয়া যায়, আর কখন যে ফিরে তা একমাত্র তাহার মা ছাড়া আর কেউ জানে না। চুলগুলিতে তেল আর চিরুনি পড়িয়াছে বলিয়া কোনোদিন কেউ দেখে নাই, পড়িলেই বরং অস্বাভাবিক দেখায়। এই শৈলেন কথাবার্তায় চমৎকার—পদ্মার দাদা বাঁচিয়া থাকিলে আজ তাহারই সমান হইত বটে কিন্তু একসময় এমন গম্ভীর যে কথা বলিতেই ভয় হয়। যেন সারা পৃথিবীর ভাবনা তাহার মাথায় আসিয়া ঢুকিয়াছে। সে সময় সে দাঁত দিয়া ভয়ানক নখ কাটে।
এইমাত্র কাপড় কাঁধে করিয়া শৈলেন স্নান করিতে চলিয়া গেল। সমস্ত বাড়িটা যেন তাহার পদক্ষেপে কাঁপিতেছে।
এই শৈলেন একদিন তাহাকে বলিয়াছিল, পদ্মা, তোমার চোখদুটো ভারী সুন্দর। — সে কথা মনে করিয়া এই মুহূর্তেও পদ্মার মনের ভিতর যা ভালো লাগিল, তা মুখে বলিবার নয়, বুকের ভিতর কেমন করিয়া উঠিল, খানিকটা সময়ের জন্য অন্তত সে গর্বে উন্নত হইয়া চোখদুটি টান এবং আরও বড়ো করিয়া অত্যন্ত করুণায় চারিদিকে তাকাইতে লাগিল।
মাসিমার ঘরে পদ্মার সর্বদাই আসা-যাওয়া আছে। মাসিমা খুবই ভালো মানুষ, আর শৈলেনদা আরও ভালো মানুষ। পদ্মা আস্তে আস্তে সেই ঘরে ঢুকিয়া অনির্দিষ্টভাবে চারিদিকে তাকাইয়া দেখিতে লাগিল। শৈলেন যে এইমাত্র আসিয়া গিয়াছে, তা ঘরের দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখিলেই বোঝা যায়। স্যান্ডেল জোড়া বিক্ষিপ্ত হইয়া এখানে একটা ওখানে একটা হইয়া পড়িয়া আছে।