—কী?
–ক-টা বাজল বলতে পার?
–একটা হবে আর কি! কেন জিজ্ঞেস করছেন?
শ্রী বিলাস বিনা আয়াসে বলে ফেলল, ওই দ্যাখো, আমিও কিন্তু ওইরকমই আন্দাজ করেছিলুম। ঠিক হল দেখছি। এখন আমি প্রায়ই পরীক্ষা করে দেখি, কি জানো, ঠিক হয়। কম আশ্চর্যের কথা নয়, কি বল?
-হ্যাঁ। আমি চান করতে চললুম দাদা।
—ওকি, এখনও খাওনি? হা ভগবান! এমন করলে কি শরীর থাকবে? এই অবেলায় খেয়ে জোয়ান বয়সেই না হয় কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে চলতে পারো, কিন্তু বুড়ো বয়সে এর জন্যে ভুগতে হবে বাপু। যাও তাড়াতাড়ি যাও–
অন্যের কাছে খুব ভালো মানুষ সেজে শ্রীবিলাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
একটু পরেই বিন্দু এল, সঙ্গে কেলো আর হেবো। সদু ঘরে ঘুমিয়েছিল।
হাত থেকে সব নামিয়ে বললে, ছেলেগুলো এমন দুষ্টু দ্যাখো, আবার বাবুদের বাসায় গেছে। কী সাহস! কতদিন মানা করলাম তবু—সেই ন্যাংটা দিগম্বর সেজে গিয়ে উপস্থিত।
শ্রীবিলাস বললে, কোনোদিন গাড়িঘোড়ার তলে পড়ে খুন হবে।
—হবেই তো।
শ্রীবিলাস বললে, আর যাসনে কিন্তু। তারপর, বউ, কেমন খাওয়া-দাওয়া হল?
–খুব ভালো। আমরা তিনজনেই পেট পুরে খেয়ে এসেছি।
–আর?
–আর এনিছিও তোমার জন্যে।
—তাহলে এবেলা আর রাঁধতে হবে না বল, শ্রীবিলাস কাছে এগিয়ে বললে, বসব?
–চান করেছ?
–সেই কখন।
–আচ্ছা দাঁড়াও, পিঁড়ি পেতে দিই।
শ্রীবিলাস তাড়াতাড়ি বললে, না থাক থাক, আমি মাটির ওপর বসতে পারব। বিন্দু তাকে খেতে দিতে দিতে বললে, আজ আর ভাত, ডাল, মাছ নয়, পুরনোয় মুখ বিষিয়ে উঠেছে। আজ পাকা লুচি, মাংস, দই, সন্দেশ।
শ্রীবিলাস হঠাৎ একমুখ হেসে উঠল।
–হাসছ যে?
–এমনি গো, এমনি।
–এমনি কেউ হাসে?
–বউ, আমি হাসি।
খেতে খেতে হঠাৎ একবার শ্রীবিলাসের গলায় ঠেকল।
বিন্দু তাড়াতাড়ি বললে, আহা, অত তাড়াতাড়ি খাচ্ছ কেন?
খাওয়া-দাওয়ার পর একটা পান চিবোতে চিবোতে শ্রীবিলাস বললে, সেই কড়িগুলো কোথায় গো বউ, সেই যে কিনেছিলে, না কোত্থেকে এনেছিলে?
—আছে বুঝি কোনোখানে, কেন?
–এসো না একটু খেলি?
বিন্দু বললে, না আমার ঘুম পেয়েছে। সারারাত একরকম ঘুমুইনি। আর তুমিই বা খেলবে কীগো, আমি যদি মিথ্যে চাল দিই?
-না, না, আমি খেলব, তুমি আনো।
বিন্দু একটা ছেড়া পাটি পেতে তার ওপর একটা বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল।
শ্রীবিলাস বললে, তাহলে আমি কী করব, ঠায় বসে থাকব?
—রোজ যা করো তাই করো। ঘুমোও, কিছু পেতে দেব?
–দাও।
শ্রীবিলাস যখন ঘুম থেকে উঠল, বিন্দু তখন অনেকক্ষণ কাজে চলে গেছে। সন্ধ্যার আর বেশি বাকি নেই।
শ্রীবিলাস সদুকে বললে তাকে কলতলায় নিয়ে যেতে।
সদু তিন বছরের মেয়ে, কিন্তু কথা বলে পাকা-পাকা। সে তার বাবার হাতের লাঠি ধরে তাকে কলের পারে দিয়ে এল।
অতগুলো গরিব পরিবারের জন্যে একটিমাত্র কল, তা-ও সারাদিন জল পড়ে যায়।
শ্রীবিলাস হাত-মুখ ধুতে এসেছিল। তাকে দেখে একজন কল ছেড়ে দিলে। সে হাত-মুখ ধুয়ে আবার ফিরে ঘরে এসে বসল।
সকলে যে যার কাজ থেকে ফিরছে।
আর শ্রীবিলাস তার ঘরের সামনেকার বারান্দায় বসে আছে চুপ করে। অনুভব করছে মানুষের পদচারণা, কথা বলা। এমনি সে রোজই বসে থাকে একা।
তার চোখের রং ধূসর, মাঝে মাঝে জল পড়ে, মাথার চুলগুলো খুব ছোটো করে ছাঁটা। পা-দুটো এক করে হাঁটুর ওপর এক হাত রেখে, তার ওপর মুখটি স্থাপন করে সে বসে থাকে। এই সময় কেউ সেধে কথা বললে উত্তর দেয় খুব। বিনীতভাবে কিন্তু অতি সংক্ষেপে।
রাত নটার সময় বিন্দু এল। আজ সে একটু সকালেই এসেছে। ছেলেরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু শ্ৰীবিলাস জেগে আছে। বিন্দু জিজ্ঞেস করলে, ওরা সব খেয়েছে?
হ্যাঁ। তুমি তো রেখে গেছলেই খাবার। কিন্তু বউ, আজ তুমি সকালে এসেছ বলে মনে হয়।
বিন্দু বললে, হুঁ। ছুটি দিয়ে দিলে। ওদের বাড়িতে আজ মেয়েরা নাচবে গাইবে। তারপর মেয়েপুরুষ মিলে থিয়েটার করবে গো—কিন্তু আমি তাতে কী কাজে লাগব বল? তাই চলে এলাম।
-তা নাচ-গান দেখে এলে না কেন?
বিন্দু মুচকি হেসে বললে, যাবে?
–কি বল? এখন? এত রাতে?
—এত রাতেই তো এলাম। তা ছাড়া আমার ওসব লোকের ভয় নেই।
খেয়ে-দেয়ে শ্রীবিলাস বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললে, নেই কেন?
বিন্দুর গরমটা সত্যি একটু বেশি, সে বাইরে গিয়ে বসেছিল।
একটু ঝিরঝিরে বাতাস বাইরে পাওয়া যায় বটে। কিছু দূরেই একটি মাধবীলতার গাছ আছে, তাতে অজস্র ফুল, সেই থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে, মাঝে মাঝে বাতাসের সঙ্গে ভেসে।
বিন্দু বললে, কারণ আমি জানি, আমি সত্যি, ওরা মিথ্যে। ওরা ভীতু।
–তবে কাকে ভয় করে শুনি?
বিন্দু বললে, তোমাকে।
শ্রীবিলাস শুয়েছিল, উঠে পড়ল, ধীরে ধীরে বাইরে এসে বললে, আমাকে কেন?
বিন্দু ফিক করে হেসে বললে, ভয় করব না তো কি? এই দ্যাখো, ছেঁড়া কাপড়, তালি দিয়ে সেলাই করে কোনোরকমে পরি। কিছুতেই আর সংসার চালাতে পারি না। এই তো আজ অর্ধেক মাস মাত্র গেছে, আমার কাছে মোটে একটা টাকা। ঘরে শুয়ে আছে তিন ছেলে-মেয়ে। ওরা বেঘোরে ঘুমুচ্চে। কিন্তু ওগো, তোমার চোখে কি ঘুম নেই? তোমার চোখের আগুন নেবাও, আমি তো আর পারিনে।
—আমি এখন শোবো না।
–শোবে না?
–না, আমার শুতে ইচ্ছে করছে না।
শ্রীবিলাস কাতরস্বরে বললে, দ্যাখো, আমি অন্ধ মানুষ, কত দুঃখ। তার ওপর আমাকে আরও কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বিন্দু, ও বিন্দু–