এ প্রসঙ্গ চাপা দিবার জন্য রণু বলিল, আপনাদের কয়টি বাড়ি পদ্মা নিয়েছে মামা? কেউ মরেনি তাতে? মুচকি হাসিয়া তিনি বলিলেন, কেউ মরেনি।
এক একটা কাজ রণু করিয়া বসে, পরে ভাবিলে হাসি পায়। একবার তাহার দুঃখ আর দারিদ্র্যের কথা বীণাদিকে বলিতে যাইয়া তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া কান্না আসে আর কি!
তবে সেদিনের কথা সত্যিই বড় মনে পড়ে। রাত্রির পৃথিবীতে সকলের অলক্ষ্যে এক অবহেলিত আত্মার কাছে দুহাত পাতিয়া সে আশীর্বাদ গ্রহণ করিয়াছে। সেদিন চারিদিকে নিস্তব্ধতায় আর দুঃখের কথায় চোখের জল আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহা সত্যি।
রণুর পরীক্ষা হইয়া গেল অর্থাৎ এদিকের সব মিটিয়া গেল।
ফল বাহির হইতে তখনও অনেক বাকি। রণু বাড়ি যাওয়া ঠিক করিয়া ফেলিল। ফেলই হউক আর পাশই হউক এরপরে আর পড়া তাহার কোনো রকমেই হইতে পারে না। তা ছাড়া, বড়দাও তাহার খরচ বাড়তির জন্য তাহাকে এখানে রাখিতে চাহিবেন না।
কাদম্বিনী সৌজন্যের খাতিরে বলিলেন, ফলটা বেরুলে পর গেলে হত না!
—দরকার নেই জ্যাঠাইমা, রণু হাসিয়া বলিল, আমি পাস করবো।
কাদম্বিনী খুশি হইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই করবি। তুই কি আমাদের অজিত, বাবা, যে বছর বছর শুধু টাকা খরচ করতে হবে?
রণু বলিল, আচ্ছা জ্যাঠাইমা, জিতু বলে একটি ছেলে যে এসেছিল এখানে ও ই যে আপনার মাসতুতো না পিসতুতো ভাই-এর ছেলে, ও বুঝি বিলেত যাবে?
—যাবে না তো কি? মস্ত বড়োলোক ওরা, তার ওপর ছেলেটাকে দেখেছিস। তো, কেমন মুখের ওপর একটা বুদ্ধির দীপ্তি। অনেকটা তোর মতো …তোরও ওরকম হতো কেবল পয়সার জোর নেই বলে।
আশ্চর্য হইয়া রণু বলিল, কী বলেন জ্যাঠাইমা? আমার হতো না, কখনো হতো না, বড়দাই বলেছে যে…
হাসিয়া কাদম্বিনী বলিলেন, কী বলেছে?
নিজেকে নিজে বকব? রণু হাসিয়া ফেলিল। কাদম্বিনীও হাসিলেন।
আশ্চর্য বটে। যাইবার সময় বীণাকে বাড়িশুদ্ধ খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। বেলা তিনটায় ট্রেন। একবার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্য।
রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বীণাদিকে খুঁজে পাচ্ছি না জ্যাঠাইমা। গাড়ির সময় হয়ে এসেছে যে!
দ্যাখ পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?
সেই হাজরাদের বাসায় বীণাকে পাওয়া গেল। সে কনকের সাথে বসিয়া গল্প করিতেছিল।
আগেই কনক হাসিয়া বলিলেন, রণু কেন আমাদের বাসায় এসেছে আমি তা জানি।
আপনার সব সময়ই ঠাট্টা বউদি, রণু বলিল।
আমার কী দোষ ভাই? বীণা তো এতক্ষণ তোমার কথাই বলছিল। তোমার পরীক্ষা হয়ে গেছে, ফল বেরোয়নি কিন্তু তার আগেই তুমি চলে যাবে, তোমার নাকি পড়বার ইচ্ছা ভয়ানক, তা হলে কী হবে? বীণা বলে যে চায় সে পায় না। তা ছাড়া আরও কত কী?…তোমার মতো ছেলে খুব কম দেখা যায় কনক হাসিয়া ভাঙিয়া পড়িলেন। আর চোখে জল ভরিয়া আসিল রণুর। কোনোদিন তাহার এ দুর্বলতা দেখা দেয় নাই, আজ কি জানি কেন দিল। সে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, বীণাদি চলুন শীগগির।
বাসায় আসিয়া রণু কী যে বলিবে খুঁজিয়া পাইল না। বীণা প্রথমে কহিল,
যেখানেই থাকি না কেন তোমাকে আমি মনে করবো ভাই।
তা জানি বীণাদি। আমিও আপনাকে কোনোদিন ভুলবো না। রণু আর বলিতে পারিল না।
তারপর গলি শেষ হইবার আগে রণু একবার পিছনপানে তাকাইয়া দেখিল সকলেই তাহার দিকে চাহিয়া আছে, নাই কেবল বীণা।
মহাপ্রয়াণ
ছয়টা বাজিয়া গেল তবু কেউ আসিতেছে না। অথচ সাড়ে ছয়টায় মিটিং। উদ্যোক্তারা অধীর হইয়া উঠিল, শেষে স্থির করিল, এমন কান্ড তাহারা জীবনেও দেখে নাই, শোকসভার অনুষ্ঠান করিতে গিয়া যে এমন বেকুব বনিয়া যাইবে, ইহা তাহারা স্বপ্নেও ভাবিতে পারে নাই। একজন একটা অত্যন্ত কঠিন মন্তব্য করিয়া ফেলিল, আজ যাহারা শোকসভার এই আড়ম্বরহীন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দ্বিধা করিতেছে, কাল যে তাহারাই আবার শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত হইতে কুকুরের মতো ঠেলাঠেলি করিয়া মরিবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই! সুবোধ ঘোর জাতীয়তাবাদী, এমনকি বাঙলাকেও ভারতবর্ষ হইতে পৃথক করিয়া দেখে, কিন্তু আধুনিক সব কান্ড-কারখানা দেখিয়া সে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভীষণ সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছিল, অত্যন্ত বিরক্তিভরা সুরে সে বলিল, বাঙালির আবার টাইম!
মৃত মধুসূদন দাস মহাশয়ের মোটরের ড্রাইভারটি খাটিতে খাটিতে হয়রান হইয়া গেল। তবুও সে তাহার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনিয়ন্তা চাকরিটাকে দাস মহাশয়ের অন্যান্য ছেলেদের মতোই উত্তরাধিকারসূত্রে অক্ষুন্ন রাখিতে পারিবে কিনা কে জানে! সভামন্ডপটাকে চমৎকার সাজানো হইয়াছে, আরামদায়ক চেয়ারে, ইলেকট্রিক লাইট ইত্যাদিতে চমৎকার। প্রেসিডেন্টের টেবিলের উপর রাশি রাশি ফুল, ফুলের মালা, মাথার উপর ঝালর দেওয়া দামি সামিয়ানা। সেই ঝালরগুলি বাতাসে মৃদু কাঁপিতেছে।
মধুসূদন এত টাকা রাখিয়া গিয়াছেন যে, তা রূপকথার মতোই শোনায়। অথচ তাঁহার জীবনের কোথাও আড়ম্বরের চিহ্নমাত্র নাই। এক পয়সা দিয়া একটা সিগারেটও কিনিয়া খান নাই কখনো। নিজের স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় স্ত্রীলোকের মুখ দেখেন নাই জীবনে। একটা মোটর কিনিয়াছিলেন তাও লোকের কথায় নিতান্ত ঠেকিয়া, কিন্তু সেই মোটরে একটি দিনের জন্যও কখনো চড়েন নাই। এমন সরল অনাড়ম্বর জীবন যাঁহার ছিল, প্রাচুর্যের ভিতর বাস করিয়াও যিনি অপ্রাচুর্যের রূপকে চিরকাল ভক্তিভরে প্রণাম করিয়াছেন, তাঁহার স্বৰ্গত আত্মার সদগতি কামনার উদ্দেশ্যেই আজ সকলে এখানে সমবেত হইবে।