বীণা আস্তে আস্তে তাহার ঘরে গেল। টেবিলের উপর বাতিটার আলো বাড়াইয়া রণুর বিছানার কাছে গিয়া ডাক দিল, রণু, অ রণু–
কয়েক ডাকের পর সে চোখ বুজিয়াই সাড়া দিল, কেন?
–চারটে যে বেজে গেছে, পড়বে বলেছিলে না?
—হুঁ! কিন্তু উঠিবার কোনো লক্ষণই তাহার দেখা গেল না। বেশি রাত্রে ঘুমাইয়া চোখ হইতে ঘুম ছুটিতে চায় না সহজে।
–আমি তো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি।
—হুঁ, দেখবে চলো, গম্ভীরভাবে বীণা রণুকে উঠাইয়া ঘড়ির সামনে আলো ধরিয়া দেখাইল। আশ্চর্য হইয়া রণু তাহার দিকে চাহিল।
বীণা বলিল, আশ্চর্য হবার কছু নেই। ওটা বেজে গেছে, কিন্তু আমাদের ঘুমকাতুরে রণুর কানে সেটা যায়নি। ভাগ্যিস আমি উঠে ডাক দিয়েছিলাম, নইলে যে কী হত!
চেয়ারে বসিয়া রণু বলিল, খুব খারাপ হত। বলিল, জুলিয়াস সীজারের কতখানি এখনও না-পড়া রয়ে গেছে। সেগুলি সারতে হবে। আবার সমস্ত পড়া রিভাইস করতে হবে, সময়ের দরকার অনেক। আমি কখন ঘুম থেকে উঠতাম কে জানে; শুতে যে রাত হয়ে গিয়েছিল!
—আমি যাই, তুমি পড়ো। বীণা চলিয়া গেল। পড়িতে পড়িতে রণুর ভোর। হইল, তারপর বেলা আটটাও বাজিয়া গেল।
বড়দা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, একটা কাজ করবে? এই যে চিঠিটা, নরেন মজুমদারের বাসা চেনো তো, সেই যে ফর্সা লম্বা লোকটা, আমার এখানে প্রায়ই আসে, ওঁকে এই চিঠিটা দেবে। তিনি তখনই এর উত্তর দিয়ে দেবেন। তুমি সঙ্গে করে তা নিয়ে আসবে। খুব জরুরি কিন্তু, বুঝলে! আর তাঁর বাসাটা কোথায়; দাঁড়াও, দাঁড়াও বলে দি তোমাকে, ইয়ে—
রণু করুণভাবে বড়দার দিকে চাহিল, এখন সে যায় কেমন করিয়া! সামনে দাঁড়াইয়া বীণা সব দেখিতেছিল। সে বলিল,-ওর কি না গেলে চলে বড়দা? পড়ার ক্ষতি হবে যে! কেন, ছোড়দা যাক না। ডেকে দেব?
ছোড়দা কিছু করে না, বসিয়া থাকে। ভোরবেলা এক কাপ চা খাইয়া সে কোথায় বাহির হইয়া গিয়াছে।
বড়দা কহিলেন, অজিত তো নেই বাসায়। কেন, ওই যাক না, এখন আর পড়ে কী হবে?
বীণা কহিল, না ওর যেয়ে কাজ নেই। অন্য কেউ যাক। বড়দা মনে মনে রাগিতেছিলেন। এই বোনটিকে আসলে তিনি কিছু ভয় করিতেন। কিন্তু বাহিরে সহজে প্রকাশ করিতেন না। ইহা তাঁহার স্বভাব নয়। নিজের কতৃত্বের অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না।
তবে এ ব্যাপারে এবার তিনি আর বেশি কিছু বলিলেন না। গম্ভীরভাবে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেলেন।
বীণা বলিল, তুমি কি রণু ! মুখ ফুটে কিছু বলতে পারো না? পরের বাড়িতে থাকো বলে কি সব কাজই করতে হবে নাকি? বড়দাকে দোষ দেওয়া যায় না। ওঁর ওটা স্বভাব। কিন্তু তাই বলে তোমার নিজস্ব কিছু নেই নাকি? ঘড়ির দিকে চাহিয়া সে বলিল, এখন আটটা বেজে পনেরো মিনিট হয়েছে। ঠিক সাড়ে নয়টার সময় স্নান করতে যেয়ো, বুঝলে? আমি মাকে গিয়ে বলছি।
বীণা চলিয়া গেল।
রণুর টেস্ট শেষ হইয়া গেল। নতুন উদ্যমে আবার সে ফাইন্যালের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল। পড়া আর পড়া—রণুর যেন ইহা ছাড়া আর কিছুই করিবার নাই।
একদিন ঘরে ঢুকিয়া বীণা বলিল, মা, রণুর জ্বর হয়েছে। আশ্চর্য হইয়া কাদম্বিনী কহিলেন, জ্বর হয়েছে? এই পরীক্ষার সময় আবার জ্বর হল? ও কী করছে এখন?
–দিলীপের সাথে ব্যাগাঠেলী খেলছে।
–ওকে শুয়ে থাকতে বলগে, আমি আসছি।
পরের দিন রণুর জ্বর কমিল না। না কমিলেও তত কাতর হইল না। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্প করিয়া খেলিয়া সেদিন তাহার কাটিল। কিন্তু তৃতীয় দিন বৈকালে জ্বর অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। রণু মাথার বেদনায় কথা বলিতে না পারিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল।
বীণা আগে ইহা লক্ষ করে নাই। সন্ধ্যাবেলা তাহার কপালে হাত দিয়া দেখে যে, শরীরের উত্তাপ ভয়ানক বাড়িয়াছে। চোখ দুটি ঈষৎ লাল আর ফুলিয়া গিয়াছে। সে ভীতস্বরে ডাকিল, রণু?
—কী?
—মাথাটা ধুইয়ে দিই, কেমন?
রণু বীণার দিকে পাশ ফিরিয়া বলিল, বীণাদি, একটা কথা বলি। আমাকে হাসপাতালে যাবার ব্যবস্থা করে দিন। বাসায় এত লোকজন, একজনকে দেখতে হলে আর একজনের পাশে তাকানো চলে না। কেন মিছিমিছি আপনারা কষ্ট করবেন? এখনও আমি উঠে যেতে পারি, পরে হয়তো পারব না। আপনি ব্যবস্থা করুন।
বীণা তাহার কপালে, চোখের পাতায়, মুখে হাত বুলাইয়া বলিল, কি বাজে বকছো রণু! আমি জল নিয়ে আসি, দাঁড়াও।
ডাক্তার আনানো হইল, তিনি ওষুধের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন। অনেক রাত্রি অবধি তাহাকে বাতাস করিয়া বীণা গিয়া শুইল। পরের দিন একরকম রহিল। রণু ঠিকই বলিয়াছিল। এত লোকদের মধ্যে শুধু অসুবিধা সৃষ্টি করা।
কাদম্বিনী বীণাকে একান্তে কহিলেন, ওর বাবাকে খবর দেব? কী বলিস?
বীণা বলিল, না, না, দরকার নেই। অসুখ এমন বেশি কী হয়েছে যে কাকাকে খবর না দিলে চলবে না! আজ যদি আমাদের কারোর এরকম হত তবে কী করতে?
-না, তা বলছি না। এই পরীক্ষার সময়, যদি খারাপ কিছু হয়ে দাঁড়ায় দোষের ভাগী হব আমরা। খারাপ কিছুই হইল না। পরের দিনই জ্বর কমিয়া গেল। রণু হাসিয়া কথা কহিল। কাদম্বিনী যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। অসুখ সারিবার পরে একদিন রাত্রে বিছানায় শুইয়া হঠাৎ রণুর কী যেন মনে পড়িয়া গেল। সারা অসুখের সময় কাহার যেন স্নেহের পরশ, তাহার দুঃখ-কষ্টের জন্য সচেতন অভিব্যক্তি, কোনোদিন অনুভব করিয়াছিল, দেখিয়াছিল, নদীর পাশে শুষ্ক বালুচরে সপ্তমীর চাঁদের অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার মতো কায়া লইয়া সে দাঁড়াইয়া। রণু হঠাৎ বসিয়া কি জানি কাহার উদ্দেশ্যে জোড় করিয়া নমস্কার করিল। সে লক্ষ করে নাই। ঘরে আছেন সেই মামা, দেখিয়া ফেলিলেন সব। রণু লজ্জা পাইল। মামা হাসিয়া বলিলেন—পরীক্ষা কাছে এলেই বুঝি অদৃশ্য দেবতার উপর দৃষ্টি পড়ে। কী বল রণু?