বীণা তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।
বড়দা বলিলেন, যান এখন রুজ পাউডার কতগুলো ধ্বংস করে আসুন গে। আর এই যে—তিনি রণুকে সম্মুখে দেখিয়া আরও ক্ষেপিয়া গেলেন,—আর একজনকে পাঠিয়েছিডেকে আনতে, তারও কোনো খোঁজখবর নেই। বুঝলে মা, এমন মেয়ে-ঘেঁষা ছেলে আমি আর কখনো দেখিনি।
মাথা নত করিয়া রণু দাঁড়াইয়া রহিল। সে এ-বাড়ির ছেলে নয়, জ্ঞাতি সম্বন্ধে একটু আত্মীয়তা আছে। খুব গরিব, এখানে থাকিয়া পড়ে।
এ বাড়ির সকলেই বড়দাকে বাঘের মতো ভয় করে। তিনি যাহা একবার মুখ দিয়া বলেন তাহা করিয়া তবে ছাড়েন। তাহাতে যদি সংসারে কোনো ওলটপালট হইয়াও যায় কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।
বড়দা কাদম্বিনীকে বলিলেন, দ্যাখো মা, লেখাপড়া জানলে অন্য সব গুণও আপনি হয়ে যায়। এ এমনই জিনিস। ওই তো, সেবার শিলং-এ গিয়ে ওঁরই সম্পর্কে এক মাসতুতো বোনকে দেখলাম। কী সুন্দর, আর কত গুণ! নিজেদের কথা মনে হলে রীতিমতো লজ্জা করে।
বীণা এবার রাগিয়া গেল। কোনোদিন সে বড়দার মুখের উপর কথা বলে না। কিন্তু আজ বলিল, আচ্ছা আমি কি নিজে থেকেই পড়লাম না, না তোমরাই আমাকে পড়ালে না—কোনটা সত্যি? আমি বলে রাখছি আমাকে এরকম করে জ্বালালে আমি কিছুতেই এ বাড়িতে থাকব না। আজ বাবা থাকলে নিশ্চয়ই এরকম কথা তোমরা আমায় বলতে পারতে না। রূপ কি সকলের থাকে? তাই বলে— বীণা আর বলিতে পারিল না—কান্না চাপিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।
ছেলের উপর কথা বলিবার শক্তি কাদম্বিনীর ছিল না। তিনি হতভম্বের মতো বসিয়া রহিলেন। বড়দার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল রণুর উপরে। তিনি একরকম চেঁচাইয়া বলিলেন, এখানে হাঁ করে কী দেখছ? যে ভদ্রলোকগুলি আমাদের মতো লোকের বাড়িতে কৃতার্থ হয়ে এসেছেন তাদের বিদায় করগে যাও। যত সব— আমার এখানে কারোর জায়গা হবে না বলে দিলাম। আরে বাপু, গরিবের ছেলে লেখাপড়া ছাড়া অন্যদিকে মন গেলে যে বাপের রক্তজল করা পয়সার মর্যাদা থাকবে না।
সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। এইরকম ঝড়ঝঞা এ সংসারে প্রায়ই আসে, নতুন কিছু নয়।
রাত্রে বড়দা ঘুমাইলে পর কিছুটা শান্ত হইল। মোটা, ঘুমকাতুরে মানুষ, অল্প রাত্রেই গভীরভাবে ঘুমাইয়া পড়েন।
সেদিনের জন্য পড়া রাখিয়া রণু উপরে বড়দার নাক ডাকার বিকট শব্দ শুনিয়া নির্ভয়ে বীণাকে খুঁজিতে গেল। তাহার শুইবার ঘরে তাহাকে পাওয়া গেল না। রণু কাদম্বিনীর কাছে গিয়া দেখিল, সেখানেও বীণাদি নাই। সে চুপি চুপি সিঁড়ি বাহিয়া ছাদের উপর গেল।
চিলেকোঠার পূর্বদিকে আলিসায় ভয় দিয়া বীণা দাঁড়াইয়াছিল। জ্যোৎস্নাময় রাত্রি, চাঁদের আলো তাহার কাপড়ে পড়িয়া ফুটফুট করিতেছিল। পাশেই ছাদ আর আলিসায় তাহারই ছায়া দীর্ঘতর হইয়া লাগালাগি দাঁড়াইয়া আছে।
রণু আস্তে ডাক দিল, বীণাদি!
বীণা প্রথমে চমকিয়া উঠিল, মুখ ফিরাইয়া তাহার দিকে চাহিয়া আবার আগের মতো দাঁড়াইয়া বলিল, কেন?
কাছে আসিয়া রণু কহিল, খেয়েছেন? বীণা চুপ করিয়া রহিল।
চলুন তাহলে, বড়দা ঘুমিয়েছে, আমিও খাইনি। জ্যাঠাইমা তো আপনাকে খুঁজছে।
বীণা এবার একটু হাসিল, বলিল, তুমি যাও রণু। পড়া হয়েছে? পরীক্ষা কবে না বলেছিলে?
খুশি হইয়া রণু বলিল, এই কালকে এক সোমবার, তার পরের সোমবার আমাদের পরীক্ষা আরম্ভ হবে। আমার কিছু পড়া তৈরি হয় নি, কী যে করব ভেবে পাইনে। তার ওপর প্রিন্সিপাল নাকি এবার বলেছেন, খুব কষে ছাত্র পাস করাবেন।
কারণ, গতবার অনেকে ফাইন্যাল পরীক্ষায় ফেল করেছিল। বড়ো ভয় করছে তাই–
রণু মুখের এমন ভঙ্গি করিল, যেন এখনই সে ফেল করিয়াছে!
করুণ চোখে রণু বলিল, কী হবে? আর পড়া হবে না, বাবা কষ্ট পাবেন, আর বড়দার মনেও আঘাত লাগবে, তাঁর বাড়িতে থেকে পড়লুম, পাস করতে পারলুম না। তখন কী যে হবে আমার ভাবতে ভয় করে। বীণা হাসিয়া বলিল, ওরে বাবা, এতেই ভয় পেয়ে গেলে? সত্যিই কি তাই হয়ে গেল নাকি? তুমি কখনো ফেল করবে না; আমি বলছি। তা যাক। আচ্ছা রণু, তুমি পাস করে তারপর কী করবে, চাকরি? তা জানি না। তবে পাটনায় আমার এক কাকা থাকেন, ভালো অবস্থা, তার ওখানে যাব।
বীণা একটু অন্যমনস্কভাবে আকাশের জ্যোৎস্নাবর্ষী খন্ড চাঁদের দিকে চাহিল, তারপর রণুর পানে স্থিরভাবে তাকাইয়া বলিল, আমার টাকা থাকলে তোমাকে আমি পড়াতাম।
রণু চুপ করিয়া রহিল, কিছুক্ষণ পরে কহিল, আমার ভাই-বোন কেউ নেই বীণাদি। কাজেই তাদের স্নেহ থেকে আমি বঞ্চিত। কিন্তু আপনাকে আমার বড়ো মনে পড়বে, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন—
হাসিয়া বীণা বলিল, কি বললে শুনি!
হঠাৎ ভয়ানক লজ্জা পাইয়া কী বলব আবার—আমি কিছুই বলিনি তো, বলিয়া তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেল।
রণুর পাশের ঘরেই বীণা তাহার ছোটো বোন লীলা আর বড়দার ছোটো মেয়ে গীতার সঙ্গে শশায়। খুব সকালে ওঠা তাহার চিরকালের অভ্যাস।
তা ছাড়া শীতকালের রাত্রি দীর্ঘ বলিয়া অনেক আগেই ঘুম ভাঙিয়া যায়। একবার ঘুম ভাঙিয়া গেলে আর সহজে সে ঘুমাইতে পারে না। তাই কখনও লীলা বা গীতাকে জাগাইয়া গল্প করে, নয়তো পাশের ঘরে তাহার মামাকে ডাকিয়া পদ্মানদীর কাহিনি শোনে।
রণুর পরীক্ষার আগের দিন শেষ রাত্রেও বীণা জাগিয়া শুনিতে পাইল, দেয়ালের বড়ো ঘড়িতে চারটা বাজিয়াছে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত পড়িয়া রণু টেবিলের ছোটো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়া রাখিয়াছিল সাড়ে তিনটায়, কিন্তু তখনও সে ওঠে নাই, বোধহয় গভীর ঘুমে অ্যালার্মের শব্দ শুনিতে পায় নাই।