কপালের কুঞ্চন হয়তো বা কিছুক্ষণের জন্যে সরল হয়ে যায়। আলোর কাছে তারই নিকটতম অবস্থিতি; তাই মুখের কোনোখানে এতটুকু ছায়াপাত হয়নি, সব পরিষ্কার দেখা যায়। অথচ কিছুই বলতে পারে না।
রাত বেড়ে চলেছে।
পরদিন অফিসে যাবার ইচ্ছে বা সামর্থ্য কিছুই ছিল না। তবু বিমল গেল এই ভেবে যে বাসায় থাকলে সামর্থ্যহীনতা আরও বাড়বে। কারোর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সামান্য কাজ করেই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।
রাণির ঘরের দরজা বন্ধ। বিমল সেখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে, অশোকের ঘরে এসে দেখল, সেখানে কেউ নেই। নীচে নেমে চাকরকে জিজ্ঞেস করলো, সে বললো, অশোকবাবু চলে গেছে, এই একটু আগে।
-মালপত্র নিয়ে?
–হ্যাঁ বাবু।
—কিন্তু আমাকে জানায়নি তো।
বিমল ব্যাকুল হয়ে ওপরে এল, রাণির বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়াল।
এই কি বন্ধুত্ব? যাবার সময় আমাকে একবার জানানোও দরকার বোধ করলে না?
জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে বিমল ডাকলো, রাণি, দরজা খোল।
দরজা খুলল। রাণির মুখ নীচু।
বিমল তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, অশোক কি চলে গেছে? কেন গেল? তুমিই বা ওকে বিদেয় দিলে কেন? কেন দিলে?
হঠাৎ রেগে গেল রাণি, বললে, কী বলছো তুমি? ইচ্ছে হয় মেরে ফেলল, তবু ওসব কথা বোলো না।
-বলব না? আমাকে সে না বলে কয়ে চলে গেল কেন? আমি একটা মানুষ নই? বিমল একটু নরম হয়ে বললে, কিন্তু তুমি অত রাগলে কেন? কাল সারারাত জেগে রয়েছি, মেজাজের কি ঠিক আছে? কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনে।
বিমল চলে এল নীচের ঘরে। চুপ করে বসে রইল।
এমনি কতক্ষণ কাটবার পর হঠাৎ বাইরে জুতোর আওয়াজ পেয়ে চমকে সে মুখ তুলে দেখল, অশোক আবার আসছে।
সে ভয়ানক খুশি হয়ে বললে, আমার ওপর রাগ কেন বলো তো বন্ধু? আমাকে বলা নেই, কওয়া নেই—সে যাক—কী হল, গাড়ি ফেল করলে?
-হ্যাঁ।
–বেশ হয়েছে। ওপরে চল।
সমস্ত বাড়িটির মধ্যে একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন কেউ মরেছে।
সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই, আকাশের পশ্চিমদিক লাল, কতকগুলি চিল এখনও উড়ছে আকাশে।
বিমল অনেকক্ষণ বেরিয়েছে, এখনও ফিরে আসেনি।
রাণি তার ঘরে বসে এমনি একটা বই-এর পাতা ওলটাচ্ছিলো। কিছুতেই মন বসে না, আর ক্ষণেক পরেই চোখ ছলছলিয়ে আসে।
হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বেরিয়ে পড়ল বই থেকে। রাণি খুলে দেখলো, তাতে লেখা : তোমার জীবনের পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালাম। অনেকদিন ধরেই একথাটা ভাবছি, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারিনি। আজ সুযোগ হল তাই করলাম। যেহেতু আমি জানি, সন্তান না হবার জন্য দায়ী আমি, আমারই দোষ, আমিই অনুপযুক্ত। নিজের জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই, কিন্তু দুঃখ হয় তোমার জন্যে। স্বামী হতে না পারলেও ভালোবেসেছিলাম সত্যি।
—তোমার আর অশোকের দীর্ঘ মাধুর্যময় জীবন কামনা করি। এ চিঠিখানা রেখে দিও, তোমার দরকার হতে পারে।
অকস্মাৎ একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতে দারুণ চমকে উঠল রাণি। তারপর সে দু হাতে নিজের মুখ ঢাকল।
মরূদ্যান
হাজরাদের বাড়ি বীণা বেড়াইতে গিয়াছে। পাড়ার অন্য দুই একটা বাসা খুঁজিয়া সেখানে রণু গিয়া তাহাকে পাইল। বীণা আরও কয়েকজন মেয়ে ও বধূর সঙ্গে বসিয়া গল্প করিতেছিল।
রণু ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়া ডাক দিল, বীণা দি, শুনে যান তো।
বীণা বলিল, ওখান থেকেই বলো।
হাজরাদের বন্ধু কনক হাসিয়া বলিল, ও, রণজিতের বীণাদি বুঝি এসেছে এখানে? নইলে কোনোদিন যে ভুলেও এ বাড়িতে পা দেয় না, সে আজ এল! বীণাদির সাথে কী কথা আছে আমরা শুনতে পারব রণু?
একটা মৃদু হাস্যতরঙ্গ খেলিয়া গেল।
রণু লজ্জায় মাথাটা ঈষৎ কাৎ করিয়া বলিল আপনি কি যে বলেন বউদি। হ্যাঁ বীণাদি, শিগগির, গোটাকতক কথা রণুর সকলের সঙ্গেই থাকে।
কনক বলল, তুমি তো এবার আই-এ দিচ্ছ, টেষ্ট কবে? এসে পড়েছে নিশ্চয়ই–
রণু মাথা নাড়িল।
-তাই তো শেষ রাতে অত পড়ার শব্দ শুনতে পাই। আহা, অত পড়লে শরীর যে খারাপ হয়ে যাবে। তোমার বীণাদি তোমাকে মানা করে না এজন্যে?
বীণা আর রণুর দিকে সকলে চাহিয়া আবার হাসিল। রণুর অবস্থা দেখিয়া বীণা তাড়াতাড়ি খাট হইতে নামিয়া আসিল। সিঁড়ি বাহিয়া নামিতে নামিতে সে জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে?
রণু বলিল, ওই যে কারা দেখতে আসবে বলেছিল ওরাই তো এসে বসে রয়েছে। বড়দা তো রাগে সারা বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন। সে ভীত দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিল।
বীণা হঠাৎ একটু উষ্ণ হইয়া বলিল, রাগ করেছে বড়ো বয়ে গেছে আমার। বলতে পারো, রোজ রোজ আমাকে এরকম সং সাজাবার মানেটা কী? রণু যেন নিজেকেই অপরাধী মনে করিল।
বাসায় আসিয়া বীণা সরাসরি তাহার মা কাদম্বিনীর ঘরে চলিয়া গেল। কাদম্বিনী বলিলেন, কোথায় গিয়েছিলি বলতো? তোকে তো আগে বলা-ই হয়েছিল, আজ ওরা দেখতে আসবে। নে, আর দেরি নয়, কাপড় বদলিয়ে আয়। ওরা আবার বসে রয়েছে।
বীণা জানালার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। কাদম্বিনী আবার কী বলিতে যাইবেন এমন সময় বড়দা আসিয়া ঘরে ঢুকিলেন। বীণাকে তেমনভাবে দেখিয়া রাগিয়া বলিলেন, এই যে, কোত্থেকে বেড়িয়ে আসা হল, শুনি? গুণবতী বোন আমার, সারাদিন কেবল মানুষের বাসায় ঘুরে বেড়ানো। আমি ভাবি যাদের বাসায় ও যায়, তারা কী মনে করে।