রাণির এতক্ষণে চমক ভাঙলো, ব্যস্ত হয়ে বললে, ওকি! কেন আপনি ওসব কথা বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। আমি তো কিছুই মনে করিনি।
–করেননি, তাহলে বসুন। অশোক এবার হাসল।
বসলে পরে বললে, আচ্ছা, এত একা আপনার কেমন করে সময় কাটে? সারাটি দুপুর–
—সে চিন্তা করে কী লাভ, কিছুই যখন হবার নয়। তবে বর্তমানে তো আর কোনো আপশোসের দরকার নেই।
-আজ নয় আমি আছি, অন্য দিন?
—সেদিন আছে ঘুম, নইলে বই!
—এসব তো আর চিরকাল ভালো লাগতে পারে না, একদিন নিশ্চয়ই বিরক্তি ধরে যাবে।
—অশোকবাবু, সেদিন আমি আত্মহত্যা করব। হয়েছে তো?
আর না পেরে এই বলে কান্না চেপে রাণি দৌড়ে পালাল।
অশোক শুধু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, যে পথে রাণির পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল সেইদিকে চেয়ে রইল।
এরপরে, দুদিন আর দেখা হয়নি, কথাবার্তাও হয়নি, যদিও দেখা করবার অবসর দুজনেরই প্রচুর। সেদিনের কথা মনে করে রাণি যেন কিছুতেই আর নিজেকে অশোকের সামনে বার করতে পারছিল না। অবস্থা আবার আগের মতোই হয়েছে।
একবার সিঁড়ির পাশে দেখা হলে পর অশোক নিজেই জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কোনো অসুখ করেছে বউদি?
-না তো।
–তবে দেখিনে কেন? অশোকের চোখের ওপর ম্লান ছায়া।
—আমিও তো আপনাকে দেখিনে।
অশোক কোনো দ্বিধা না করে বললে, কেন এমন হল বলতে পারেন?
–জানি না।
—আমি কিন্তু জানি।
–তবে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
—আপনাকে ছাড়া আর কাকে করব? রাণি যেন সবে সহজ হয়ে দাঁড়ল। সেদিন দুপুরেই দেরাজ থেকে নতুন। একখানা টকটকে লাল সিল্কের শাড়ি পরে রাণি খুব ভালো করে প্রসাধন সেরে অশোকের ঘরে গেল।
লাল শাড়ি! যেন আগুনের মাঝে সীতা দেবী।
অত্যন্ত আনন্দে অশোক কেবল বললে, বউদি!
রাণি তার কাছে এসে একটু হেসে বললে, আপনার দেওয়া কাপড়, অশোকবাবু।
–নাকি? আমি তো ভুলেই গেছি। তাহলে আপনাকে কখনো না দেখেও একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলাম সত্যি, নইলে আর এত ভালো মানিয়েছে কী করে?
রাণির মুখে মধুর লজ্জার রঙ ফুটে উঠল।
অশোক বললে, এটা এতদিন পরেননি কেন?
রাণীর মুখে উত্তর নেই, তার নিঃশ্বাস চেপে আসছে। শাড়ির পাতলা আঁচল বাতাসে উড়ছে।
আবার সেই রাত হল। বিমলের তাস খেলা তখনও পুরোদমে চলে। ভয়ানক শীত, চারদিকে সাদা কুয়াশা, নিস্তব্ধ শহর। সমস্ত শরীরে গরম কাপড় জড়িয়ে পথে কদাচিৎ মানুষের যাতায়াত, তাদের চকিত পদধ্বনি, আর রাত্রির নিঃশব্দ গতি।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রাণি অগ্রসর হল।
অশোক এখনও ঘুমোয়নি। ভেজানো দরজা, একটু ফাঁকা রাণি চেয়ে দেখল, আলোর সামনে বসে অশোক কী ভাবছে।
তার পা দুটি অবশ, বুকে অসহ্য দাপাদাপি। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। তার চারদিকে কেবল অন্ধকার।
কিছু আগেই শোবার ঘর, কিন্তু এতটুকু পথ হাঁটতেই সে যেন ক্লান্ত, দাঁড়াতে পারছে না। রাণির চোখ ফেটে জল এল।
তারপর, হঠাৎ একটু অন্যমনস্কতায় ওদিকে সরতে গিয়ে একটা কী যেন লাগলো পায়ে, হল প্রবল শব্দ। অশোক বললে, কে? আর রাণি ভয়ানক ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে একেবারে দরজায় খিল দিল। বুক দারুণ কাঁপছে, যেন কিছু চুরি করেছে আর কি!
রাত যখন একটা তখন বিমলের তাসের আসর ভেঙেছে। বন্ধুরা চলে গেলেন, নীচের ঘরের আলোও নিভল।
বিমল আস্তে ঘরে ঢুকে আগের মতো সেই চেয়ারে বসল।
টেবিলের উপর আলোটা আজ ভয়ানকভাবে জ্বলছে, সে আবার উঠে বাতিটা একটু কমিয়ে দিলে, তারপর স্থির হয়ে বসল।
আর একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামে টানতে লাগল।
আজও জানালা খোলা, ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বিমল আর কী করে, উঠে জানালা বন্ধ করে আবার বসল। সিগারেটের অনেকখানি পুড়ে গেছে, ছাই কমেছে, আস্তে একটু ঝেড়ে ছাইগুলো ফেলে সে আবার খেতে লাগল।
দেয়ালে ঘড়ির টিক টিক শব্দ।
ঘরটি অন্যদিন বেশ পরিষ্কার থাকে, আজ একটু অগোছালো, আলনার কাপড়–জামায় শৃঙ্খলা নেই, মেঝেতে কাগজের টুকরো। টেবিলের ওপর দু-তিনটি বই ছড়ানো, খাটের নীচে রাণির দুটি স্লিপারের একটি ওই কোণে।
বিমলের সিগারেট শেষ। সেটা মেঝেতে পিযে আগুন নিভিয়ে সে বাইরে ফেলে দিলে। কী ভেবে একবার আলোটা বাড়িয়ে খাটের কাছে এল। রাণি ঘুমিয়ে রয়েছে। মুখে দেহে যেন অনেকদিন পরে সাজগোজের ছাপ। চুলগুলো ভালো করে বাঁধা, ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলকালার, মুখটা চকচক করছে, কানে নতুন পরা একজোড়া দুল, গলায়ও নতুন হার, হাতে অনেকগুলো চুড়ি।
বিমল আবার চেয়ারে গিয়ে বসল।
রাণির নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায়।
ঘড়িতে টিক টিক শব্দ।
হঠাৎ কান্নার শব্দে বিমল চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, রাণি ঘুমের ঘোরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সে তাড়াতাড়ি তার কাছে গেল,-রাণি, রাণি, ওকি? ওঠো। কাঁদছো কেন? ওঠো।
কয়েক ডাকেই সে উঠল। ঘুমজড়িত চোখে বলল, কী হয়েছে?
তুমি কাঁদছো?
রাণির হয়তো কিছু মনে হল, তাই যেন খুব ভীত হয়ে আবার বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল।
বিমল আর একটি কথাও বললে না, নিঃশব্দে নিজের জায়গায় ফিরে এল। ঘরের কোণে, আর নানা জিনিষপত্রের পেছনে ছোটো ছোটো অন্ধকার, টেবিলের উপর সবখানে পৌঁছোতে পারেনি। পেরেছে দেয়াল আর মেঝেতে, খাটে শায়িত রাণির গায়ে…।
বিমল এই আলোর সঙ্গে সমদৃষ্টিতে চেয়ে সবই দেখেছে, কিছুই তার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে কী যেন হয়, তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে, দেহ অবশ হয়ে আসে।