-আপনি ঘুমিয়েছিলেন আর আমি এদিকে ডেকে ডেকে হয়রান! অশোক বললে।
রাণি হেসে বললে, আমার তাহলে অন্যায় হয়েছে।
—কিছু নয়। আপনি আসুন। আহা, দাঁড়িয়ে রইলেন যে! তাড়াতাড়ি আসুন, দেখে যান একটা জিনিষ–
অশোকের যেখানে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে সেই ঘরে সে গেল, পেছনে রাণি, একটা কৌতূহল নিয়ে।
অশোক দেয়ালের গায়ে রাণি-বিমলের একসঙ্গে তোলা একখানা ফটোগ্রাফ দেখিয়ে বললে, এটা তো বিয়ের অল্পকাল পরেই তোলা, না?
রাণি অনেকদিন সেদিকে ভালো করে তাকায়নি, আজ দেখে মনে মনে শিউরে উঠল, ফটোটা যেন তাকে ব্যঙ্গ করছে, সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে কোনোরকমে বললে, হুঁ।
–তবে আমাকে এককপি পাঠাননি কেন?
–আমি কি জানতুম যে–রাণি জোর করে একটু হাসল।
অশোক এ প্রসঙ্গে আর অগ্রসর না হয়ে বললে, বারে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন। রাণি হাসলো।
অশোক বললে, গল্প বলুন বউদি, গল্প বলুন।
-কী বলব?
-বাঃ, এই পঞ্চম বৎসরে কোনো কাহিনিই কি রচিত হয়নি? হা ভগবান? অশোক যেন সত্যি বড়ো হতাশ হল।
রাণি জোর করে হেসে বললে, সে কাহিনি কি সকলের কাছেই বলা যায়?
—নিশ্চয়ই নয়। সে কাহিনি শোনবার অধিকার কারোর নেই। আমার ভুল হয়েছে।
অশোক সরলভাবে হাসতে লাগল।
রাণির এখন লজ্জায় লাল হবার কথা, কিন্তু হল নীল। কিছু বলতে পারল না।
চুপ করে বসে থাকা অশোকের স্বভাব নয়, বললে, না, এরকমভাবে তো চলতে পারে না। বউদি, তাস আছে?
-আছে, কেন?
–দুহাত ব্রিজ খেলব, নিয়ে আসুন তো। রাণি হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার দেখল, মশারির ওপরে বিছানার তলায়, দেয়ালের সবখানে খুঁজে দেখল, কিন্তু পেল না। কি মজা, এর আগে সে নিজে আরও কয়েক জোড়া তাস ছিড়ে ফেলেছে রাগে, আজ তাকেই আবার নিজের প্রয়োজনে খুঁজতে হল।
সব জায়গাই দেখা হয়েছে, এবার আলমারির ওপরটা বাকি। কোমরে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে, একটা চেয়ার আলমারির কাছে এনে, সে তার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, হ্যাঁ, সত্যিই আছে একজোড়া নতুন তাস।
এত দেরী দেখে এমন সময়ে অশোক এসে ঘরে ঢুকল, তাকে এমন অবস্থায় দেখে হেসে উঠল, বললে, উদ্যোগ-পর্ব এখনও শেষ হয়নি নাকি?
আস্তে আস্তে নামতে নামতে রাণি হেসে বললে, হয়নি। এখন ভেবে দেখুন, এর পরের পর্বটা কীরকম হতে পারে!
রাণি আলমারির কাছে চেয়ারটা সরাতে যেতেই অশোক বললে, আপনি যান, শাফল করুন গে, আমি সব ঠিক করছি।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে বিমল রাণিকে অত্যন্ত খুশি দেখতে পেল। এই দেখে তার পাঁচ বছর আগেকার কথা মনে পড়ে গেল। সেই আলোকিত দিনগুলোর কথা আজ এখন একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তখনকার দিন আর রাত্রিগুলো যেন হাতের মুঠোর মধ্যে আনন্দে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে থাকত, আর বলরুমের পিছল মেঝেতে পা চালানোর মতো নিঃশব্দে গড়িয়ে যেত। কিন্তু আজ?
বিমল বললে, আজ কোনো সুখবর আছে নাকি! খুশি দেখছি যে বড়ো?
—আছে, রাণি হেসে বললে, অশোকবাবু আজ সর্দারী করে নিজের হাতে চা বানাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন।
—এটা কি সুখবর হল?
—তা নয় তো কি? অত সর্দারী কেন? আমি কত বললাম—
–কই সে?
বিমল অশোকের ঘরে গিয়ে দেখল, সে একটা বই পড়ছে।
বললে, কীরে চন্ড, কোথায় দাহন হল?
-খুব বেশি নয়। অনামিকার এই অগ্রভাগ।
অশোক শান্ত ছেলে হয়ে শুদ্ধ বাংলার অবতারণা করে আঙ্গুলটিই দেখাল, বললে, আমার একটুও দোষ নেই। বউদির মতো এমন দুষ্টু আর দেখিনি
দুজনের মাঝে এইসব কথার পেছনে হাস্যমুখর দৃশ্যাভিনয়ের মতো কতকটা কল্পনা করে বিমলের চোখ দুটো করুণ হয়ে উঠল।
রাণি কাছেই ছিল, বললে, আবার বউদির নামে কী লাগানো হচ্ছে? দুদিনের চেনা দুদিন পরেই আবার চলে যাবেন, কেন অনর্থক একজন নিরীহ মানুষকে দোষ দেওয়া বাপু!
-ওঃ, সত্যি কথা বললেই বুঝি ভালো লাগে না?
অশোক মুচকি হাসল। বিমল চলে এল।
আবার সন্ধ্যার ছায়া। রাত্রি। জানালায় উজ্জ্বল আলো উঁকি মারে, পথের পাশে শ্রান্ত আলো; রাতের কুয়াশা, রুদ্ধ গৃহে গৃহে চুড়ির শব্দ, আর চাপা কথা, নিঃশ্বাস। আর বিমলের নীচের ঘরের চারটি প্রাণীর চোখে ঘুম নেই।
বিমলের এখন অফিসে যাওয়ার সময়। রাণি আজ তাকে বাইরের দরজা অবধি এগিয়ে দিলে। কিন্তু এ দেখে আর কারোর না হোক বিমলকে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হতে হবে। কিন্তু সে কিছু বললে না।
কিন্তু দুপুরের ঢিমে-তেতালা সময়ে যতই চেষ্টা করুক নিজেকে দরজা বন্ধ করে রাখতে; মনকে কোথায় যেন আকর্ষণ করছিল, যা কিছুতেই থামানো যায় না। পা এগিয়ে চলল। গন্তব্য স্থানেও পৌঁছল। অশোক বিস্ময়ে বললে, আপনি!
রাণির মাথাটি কতকটা নীচু হয়ে আসছে।
—কিন্তু দেখুন বউদি দোহাই আপনার, অমন আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ করে থাকবেন না, আমার ভয় করে, ভালো লাগে না।
রাণি অনেক কষ্টে মাথা তুলে একটু হাসল।
–বাঃ, আপনাকে আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে! অশোক বলেই ফেলল।
অতি আপনার জন ছাড়া আর এক পুরুষের সম্মুখে রূপ বর্ণনায় বোধহয় কেউ সপ্রতিভ থাকতে পারে না, রাণিও পারল না, অধোবদন হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইল।
একটু দুঃখ পেয়ে অশোক বললে, দেখুন বউদি, যদি আমার কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, ক্ষমা করবেন। বাপ মা বোন ভাই কেউ নেই, স্নেহের স্পর্শ কোনোকালে একদিন পেলেও আজ আর চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনে। তাই ভুলচুক হওয়া স্বাভাবিক।